গোপালগঞ্জের কাশিয়ানীতে ভুয়া প্রত্যয়নপত্র দিয়ে জীবিত ব্যক্তিকে মৃত দেখিয়ে বয়স্কভাতা বন্ধের অভিযোগ উঠেছে পারুলিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শফিকুল ইসলাম শাওন ও নারী সদস্য আসমা বেগমের বিরুদ্ধে বিরুদ্ধে।
ভাতা বন্ধ করে দেয়ায় অর্থিক অনাটনে পড়েছেন ওই ভুক্তভোগী। এলাকাবাসী বলছে, উদ্দেশ্যপ্রনিতভাবে ওই নারীকে মৃত দেখিয়ে ভাতা বন্ধ করা হয়েছে। তবে চেয়ারম্যান পুরোপুরি সমাজ সেবার অফিসের বিরুদ্ধে দায় চাপালেও সমাজসেবা বলেছে এসব সনদ চেয়ারম্যান ও মেম্বরাকেই দিতে হয়।
এ ঘটনায় আদালতে সোমবার (২৫ মার্চ) ভুক্তভোগী আয়না বেগম বাদী হয়ে গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী আমলী আদালতে মামলা দায়ের করেছেন। আদালত মামলাটি আমলে নিয়ে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) তদন্তপূর্বক প্রতিবেদন জমা দিতে নির্দেশ দিয়েছেন।
ভুক্তভোগী আয়না বেগম কাশিয়ানী উপজেলার পারুলিয়া ইউনিয়নের শিবপুর গ্রামের আব্দুল রউফ মোল্যার স্ত্রী। জীবিত ব্যক্তিকে মৃত দেখিয়ে ভাতা বন্ধ করা হয়েছে এমন খবর গ্রামে ছড়িয়ে পড়লে ওঠে আলোচনা সমালোচনার ঝড়।
দ্রুত দোষী ব্যক্তিদের কঠোর শাস্তিসহ ভাতা চালু দাবী স্থানীয়দের। গত রবিবার (৩১ মার্চ) সকাল কাশিয়ানীর উপজেলার শিবপুর গ্রামের ভুক্তভোগী আয়না বেগমের জরাজীর্ণ বাসায় দিয়ে দেখা যায়, আয়না বেগমের বয়সের ভারে এখন চলাফেরা করাই যেন দায়।
দুই মেয়ের বিয়ে হয়ে গেলেও রোগে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘ ১০ বছর ধরে বিছানাশয্যা একমাত্র উপায্যনক্ষম স্বামী আব্দুল রউফ। তাকে নিয়ে অন্যের জায়গায় বাসবাস করে আসছেন। শয্যাশয়ী স্বামী খাটে শুয়ে রয়েছেন, তার পাশেই বসে আসেন আয়না বেগম। ২০১৭ সাল থেকে সরকারী বয়স্ক ভাতার টাকা ও প্রতিবেশিদের দেয়া সহযোগীতা নিয়েই কোন রকমে চলছিল আয়না বেগমের জীবন।
কিন্তু ভাতা বন্ধ হওয়ায় অর্থিক অভাবে চোখের পানি ফেলছিলেন তিনি আর আঁচল দিয়ে মুছছিলেন তিনি। ঘরে খাবার না থাকায় ও পচাগলা পান্তা দিয়ে সেহেরী করতে না পারায় রোজও রাখতে পারেননি তিনি। জানাগেছে, গত দুই মাস বয়স্ক ভাতার টাকা না আসায় উপজেলা সমাজসেবা কার্যালয় গিয়ে খোঁজ নিয়ে দেখেন তিনি ‘মৃত্যুবরণ’ এমন প্রত্যয়নপত্রের কারনে তার ভাতা বন্ধ রয়েছে। গত ২০২৩ সালের ৬ সেপ্টেম্বর আয়না বেগম মারা গেছেন উল্লেখ করে ইউপি চেয়ারম্যান শফিকুল ইসলাম একটি প্রত্যয়নপত্র দেন।
সেই প্রত্যয়নপত্রে সনাক্তকারী হিসেবে স্বাক্ষর করেন ওই ইউনিয়নের ১, ২ ও ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সংরক্ষিত নারী সদস্য আসমা বেগম। পরে বিষয়টি নিয়ে চেয়ারম্যান ও নারী সদস্যের কাছে গেলে কোন সমাধান তো দেয়নি বরং খারাপ আচারণ করা হয়। ভূক্তভোগী আয়না বেগম বলেন, ‘আমি জীবিত থাকার পরও চেয়ারম্যান ও নারী ইউপি সদস্য আমাকে মৃত দেখিয়ে আমার বয়স্ক ভাতার কার্ড বাতিল করে দিয়েছে। আমি শয্যাশায়ী স্বামীকে নিয়ে অন্যের জায়গায় থাকি।
এ ভাতার টাকা দিয়ে অসুস্থ স্বামীর ওষুধ কেনার পাশাপশি খাবার কিনে থাকি। বিষয়টি নিয়ে ইউপি চেয়ারম্যান ও নারী সদস্যের কাছে গেলে কোন সমাধান দেয়নি বরং উল্টো অসৌজন্যমূলক আচরণ করেন। সেই সাথে আমকে হুমকি-ধামকি দেন। আমি এর বিচার চাই।’ তিনি আরো বলেন, এ ঘটনায় আমি সুবিচার পাওয়ার আশায় বাদী হয়ে ওই ইউপি চেয়ারম্যান ও নারী সদস্যের বিরুদ্ধে আদালতে একটি মামলা দায়ের করেছি। এলাকাবাসী ফুল মিয়া মুন্সি বলেন, আয়না বেগম আমার চাচী হন।
গত দুই বাস বয়স্ক ভাটার টাকা না আসলে বিষয়টি তিনি আমাকে জানান। পরে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি তাকে মৃত দেখিয়ে ভাতা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। উপজেলার সমাজসেবা অফিস বলে, চেয়ারম্যান ও নারী সদস্য আয়না বেগম মারা গেছেন বলে প্রত্যায়ন দিয়েছে যে কারনে ভাত বন্ধ করা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে চেয়ারম্যান ও নারী সদস্যকে জানালে তারা দূর্ব্যবহার করে হুমকী দেন।
আমি এ ঘটনায় দোষীদের শাস্তি দাবী জানাই সেই সাথে ভাতা চালুর দাবী জানাই। তবে এ ঘটনায় অভিযুক্ত নারী সদস্য আসমা বেগমের বক্তব্য নিতে ইউনিয়ন পরিষদ ও পরে তার বাড়ীতে গেলেও খুঁজে পাওয়া যায়নি। পরে তার মোবাইলে ফোন করা হলে প্রথমবার না ধরলেও দ্বিতীয়বার ফোনটি রিসিভ করলে সাংবাদিক পরিচয় পাওয়ামাত্র ফোনটি কেটে দেন। পরে আজ বুধবার আবারো ফোন করে তার বক্তব্য চাওয়া হলে তিনি বলেন, আদালতে আমার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে।
আমি আদালতেই বুঝবো বলে, ফোনটি কেটে দেন। এ ব্যাপারে অপর অভিযুক্ত পারুলিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শফিকুল ইসলাম শাওনের বক্তব্য নেয়ার জন্য প্রথমে ইউনিয়ন পরিষদে গেলে তাকে পাওয়া যায়নি। পরে তিনি ঢাকায় অবস্থান করছেন জানার পর তার মোবাইলে ফোন করা হলে তিনি সাংবাদিক পরিচয় পাওয়ার সাথে সাথে খারাপ আচারণ শুরু করেন।
এরপর তিনি বলেন, ‘যখন লাইফ ভেরিভিকেশন হয়েছে, তখন ওই বৃদ্ধাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। এরপর এলাকায় মাইকিং করা হলেও তিনি আসেননি। আয়না বেগমমহ ৮ জনের বিষয়ে প্রত্যায়নপত্র দেয়ার জন্য সমাজসেবা অফিসের চাপ দেয়। সেই চাপের কারনে আমার মৃত দেখিয়ে প্রত্যায়ন দেই। তবে তার ভাতা আবারো চালু করার বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। আশা করি বিষয়টি সমাধান হয়ে যাবে।’ বাদীপক্ষের আইনজীবী আব্দুল্লাহ আশিক জামান উপল জানান, জীবিত ব্যক্তিকে মৃত দেখানোর ঘটনায় ভুক্তভোগী নারী আয়না বেগম বাদী হয়ে ইউপি চেয়ারম্যান ও নারী সদস্যকে আসামী করে আদালতে মামলা দায়ের করেছেন।
মামলাটি আমলে নিয়ে আদালত পিবিআইকে তদন্তপূর্বক প্রতিবেদন দিতে নির্দেশ দিয়েছেন। তবে চেয়ারম্যানের অভিযোগ অস্বীকার করে কাশিয়ানী উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা শেখ বজলুল রশিদ বলেন, চেয়ারম্যান ও নারী সদস্যের স্বাক্ষরিত প্রত্যয়নপত্রের ভিত্তিতেই ভাতা বাতিল করা হয়েছে। এখানে আমাদের কোন দায়বদ্ধতা নেই।’ গোপালগঞ্জ সমাজসেবা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক হারূন-অর-রশিদ বলেন, বিষয়টি আমার জানা ছিল না।
আপনাদের (সাংবাদিক) কাছ থেকে জানতে পারলাম। এখানে চাপ দেয়ার কোন সুযোগ নেই। চেয়ারম্যান ও নারী সদস্যের স্বাক্ষরযুক্ত প্রত্যয়নপত্রের কারনেই ভাতা বন্ধ করা হয়েছে। বিষয়টি তদন্ত করা হবে, সেই সাথে ওই নারীর ভাতা যাতে আবারো চালু হয় সেই ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে। তিনি আরো জানান, আমাদের কাছে আবেদন করলে তাতক্ষতিক ভাবে অনুদান দেয়া হবে। যাতে তার কোন কষ্ট না হয়।
Leave a Reply