মনিরুল ইসলাম মেরাজ গাজীপুর প্রতিনিধি
বিশ্ববিখ্যাত ইংরেজ কবি ও দার্শনিক জন মিল্টন বলেছিলেন, “মনিং শোজ দ্য ডে” অর্থাৎ-সকাল দেখে বুঝা যায় দিনটি কেমন যাবে। কিন্তু ২০২০ সালের শুরুটা দেখে ধারনাই করা যায়নি ভয়ানক মহামারির উৎকন্ঠায় মোড়ানো বীভৎসময় এমন একটি বছরের মুখোমুখি হতে হবেগোটা বিশ্বকে। বার বার রূপ পাল্টানো বিভীষিকাময় এ বছরটি বিষ্মৃতি হওয়া সম্ভব নয়। মৃত্যুর মিছিল আর আপনজন হারানোর বেদনার সাথে চাপা আতঙ্ক সাথে যোগ হয়েছিলো সংক্রমনের কারনে মানুষের প্রতি মানুষের ভয়। যে হারিয়েছে সে বুঝেছে জীবন কী!! ‘”কোটি কোটি ছোটো খাটো মরণেরে লয়ে বসুন্ধরা ছুটিছে আকাশ পানে হেসে খেলে মৃত্যু চারিপাশে এ ধরনী মরণের পথ এই জগৎ মৃত্যুর জগৎ..” কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জীবনের হিসাবটা বেশ ভালো করেই বুঝিয়েছেন তার ‘অনন্ত মরণ’ কবিতায়। সময় ও স্রোত কখনো কারও জন্য অপেক্ষা করে না “তবে সময় আমাদের শিখিয়ে যায় কিভাবে বাঁচতে হবে কীভাবে বাঁচাতে হবে। অনেক সময় তো সময়ই জীবনে মানে বুঝিয়ে দেয়। ২০২০ সালটা যেমন আমাদের বাঁচতে শিখিয়েছে ঠিক তেমনই জীবনের মানেটা বুঝিয়ে দিয়েছে। বিশে বিশ দুটি শব্দে জাকজমকভাবে বছরের শুরুটা হলেও অদৃশ্য ভাইরাসের কবলে যেন কোনঠাসা হয়ে পড়ে সবাই। শুরুটা হয়েছিল ৩১শে ডিসেম্বর ২০১৯ তারিখে চীনের উহানে অজানা ভাইরাস সংক্রমনের খবর প্রকাশের মধ্য দিয়ে। এরপর ৫ই জানুয়ারি ২০২০ তারিখে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নতুন ভাইরাসের মাধ্যমে একটি রোগ ছড়িয়ে পড়ার প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ১২ জানুয়ারি চীন নভেল করোনা ভাইরাসের জেনেটিক সিকোয়েন্স প্রকাশ করে। ৩০শে জানুয়ারি বিশ্বজুড়ে জরুরি অবস্থা জারি করে ডব্লিউএইচও আর এর মধ্য দিয়েই শুরু হয় বাঁচার লড়াইয়ের একটি অধ্যায়। ১২ই ফেব্রুয়ারি কোভিড-১৯ নামকরনের মাধ্যমে পূণর্তা পায় বিষয়টি। ২৫শে মার্চ থেকে বাংলাদেশে লকডাউন করার পর মানুষ বুঝতে পেরেছিল সময়টা খারাপ হতে চলেছে। হয়েছে তাই, চারদেয়ালে বন্দি আর একাকিত্ব বুঝিয়েছে মানুষ মরণশীল। প্রথম ধাক্কাটা যেমন পড়েছিলো স্বাস্থ্যখাতে ঠিক তেমনই বুঝিয়ে দিয়েছে এটা কতটা জরুরি। করোনা আলাদা করেছে মা আর সন্তানকে, ভালোবাসার বিচ্ছেদ ঘটিয়েছে স্বামী আর স্ত্রীর মধ্যে আর হাসপাতালের দেয়ালে আপনজনের কান্না সাক্ষী ছিল মানুষ মানুষের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ন। মানুষের জীবিকা আর অর্থনিতীর চাকা যেন মৃত্যুর প্রশ্নে এক জায়গায় থেমে গিয়েছিলো। কতশত ত্রান নিয়ে খেলতে দেখা গেছে কিছু পশুদেরকে। তবে সকল খারাপের সীমা ছাড়ানো একটা অধ্যায় ছিলো শাহেদ আর সাবরিনাদের করোনা টেস্ট জালিয়াতি আর মানুষের জীবন নিয়ে খেলার বিষয়টি। স্বাস্থ্যখাতকে তারা করেছেন কলঙ্কিত। সব ছাপিয়ে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে মোট আক্রান্ত ৮২৪৮১৪৬৬ জন আর মৃত্যু হয়েছে ১৮০০১৮০ জনের। অনেকটা আশা জাগিয়েছে সুস্থ হওয়ার সংখ্যাটি যা ৫৮৫০৭৭৫৮ জন। দেশে করোনা ছড়িয়ে পড়ার পর অর্থনিতী টের পেয়েছিলো ঘাতটির ভোগান্তি কতোটা। জিডিপির পরিমান ২০১৯ এর ৮.১৫ থেকে নেমেছে ৫.২৪ তে। গরীবের ধন বেসরকারী ঋনও নেমেছে ৯.৮৩ থেকে ৮.৬১ তে। রাজস্ব যেন হাঁপানি তোলার মতো যা কিনা ২০১৯ সালে ২১.৯২ থাকলেও ২০২০ সালে হয়েছে ১.৯৬। রপ্তানি ২.৮৯ থেকে বিশে এসে ০.৭৬ এ এসে ঠেকলেও আমদানি বেড়েছে ২গুন। তবে সকল খারাপ খবরের মধ্যে আমাদের রেমিটেন্স যোদ্ধারা হাল ধরেছিলেন মূল অর্থনিতীর আর সত্যিই গর্ভবোধ করতে শিখেছে জাতি। সাধারন মানুষের যখন নাভিশ্বাস অবস্থা তখনই নিত্যপন্যের বাজারের উত্তাপ শুরু হয়। পেঁয়াজ আর আলু যেমন বিক্রেতাকে বোকা বারিয়েছে তেমনই চালের বাজার অনাহারে রেখেছে নিন্মবিত্ত মানুষকে। ভোগ্যপন্যের আকাশছুঁয়া দামে সরকারী বেসরকারী ত্রান কিছুটা আশা যোগালেও গরীবের পেটে লাথি দিয়ে প্রভাবশালীরা নিজেরা গিলেছেন সেগুলো। মর্মান্তিক হলেও সত্য করোনার সময়টাতে মানুষ অনাহারেও মারা গিয়েছে। জীবন বাঁচানো যেখানে দায় সেখানে শিক্ষা তো বিলাসিতা মাত্র। মার্চ থেকে তাইতো পড়ালেখায় লেগেছে তালা। তবে মন্দের ভালো অনলাইন ক্লাস ভালোই সম্ভবনা যোগিয়েছে। মেজর সিনহা হত্যার পর প্রশ্নবিদ্ধ পুলিশ প্রশাসন আর ধর্ষনের লাগামহীন গতি জাতিকে করেছে কলঙ্কিত। শফীর মৃত্যু নিয়ে ধোয়াশার সাথে ভাস্কর্য ইস্যু যেন যোগ করেছিলো নতুন মাত্রা। তলাবিহীন ঝুড়ির জবাবটা এবার পদ্মাসেতুর সবকটি স্পেন বসানোর মাধ্যমে গুছে দেওয়া হয়েছে। করোনার সময়ে বড় বড় প্রনোদনা যেমন ধস ঠেকিয়েছে তেমনই বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ স্বস্তি দিয়েছে। প্রবিদ্ধি কমলেও বেড়েছে দারিদ্রতা আর তার সাথে ফাঁপানো ব্যাংকখাত এবং ঋন বিতরণে স্থবিরতা ভালোই ভুগিয়েছে। বিনিয়োগের তলানিতে বেকারত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে কয়েকগুন। আন্তর্জাতিক বিষয়ে যুক্তরাষ্টের উত্তাল নির্বাচনে ট্রাম্পের হার আর করোনার ছোবলে সব দেশের সীমান্তে দেয়াল উঠায় পরষ্পর বিরোধী দেশগুলো শূণ্যতা ভালোভাবেই টের পেয়েছে। মেরাডোনার কফিনবন্দী হওয়ার বেদনা যেন ম্লান হয়েছিল সাকিবের ফিরে আসার আনন্দে।তবে দর্শকহীন গ্যালারী আর খেলোয়ারহীন স্টেডিয়াম খেলাপ্রেমীদের কাঁদিয়েছে। তবে কষ্টের ফল যে মিষ্ট হয় তা বলার বাকি থাকে না। একুশ হবে বেঁচে থাকার আনন্দে ভরপুর আর মানুষ হবে মানুষের জন্য। তাইতো বলি- একুশ এসে দেশটা করুক পরম সুখে অলঙ্কিত নতুন বছর হোক জীবনে শক্তি সাহস বল অঙ্কিত।
Leave a Reply