শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪, ০৮:২২ অপরাহ্ন
শিরোনাম :

মাগুরার গ্রামে গ্রামে লাগামহীন সুদে কারবারিরা সামাজিক বিশৃঙ্খলার আশঙ্কা

Reporter Name
  • Update Time : বৃহস্পতিবার, ৫ নভেম্বর, ২০২০
  • ২১৯ Time View

অনুসন্ধানী রিপোর্ট মোঃ ফেরদৌস রেজা সুদে কারবার বা সুদে ব্যবসা এই কথাটার সাথে বাংলাদেশের মানুষ কমবেশি অনেক আগ থেকেই পরিচিত, ব্যাংক ঋণ ব্যবস্থা জটিল ও সহজলভ্য না হওয়ায় গ্রাম তথা শহরের মানুষও চড়া সুদে মহাজনের কাছ থেকে যে ঋণ নিয়ে থাকে সেটাই মূলত সুদে ব্যবসা বা কোথাও কোথাও দাদন ব্যবসা নামে পরিচিত। মূলত গ্রামের গরিব শ্রেণীর মানুষ যারা ব্যাংকের কঠিন শর্তের বেড়াজাল পেরোতে পারে না তারাই এই চড়া সুদের ঋণ গ্রহীতা। কোন কারনে যদি ঋণ গ্রহীতা টাকা দিতে না পারেন তাহলে সুদে কারবারিরা তার স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি সহ বাড়ির ভিটেমাটি দখল করে নেয়। এইজন্য রাষ্ট্রীয় আইনে এটা যেমন অবৈধ তেমনি ইসলামিক আইনে এটা কবিরা গুনাহ। সূরা আল ইমরান ও আল বাকারাতে মুসলমানদের জন্য সুদের ব্যবসা কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে। সম্প্রতি মাগুরাতে গ্রামে গ্রামে মহল্লায় মহল্লায় জমে উঠেছে ভয়াবহ এই সুদে ব্যবসা। আমাদের অনুসন্ধানে দেখা গেছে মাগুরার জাগলা, লক্ষ্মীপুর, আঙ্গরদাহ, নিধীপুর, মাঝগ্রামসহ আশেপাশের গ্রামগুলোতে ব্যাপকভাবে এই সুদে ব্যবসা ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। নারী, পুরুষ, ছোট-বড় সকল শ্রেণীর মানুষ এই ব্যবসার সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়েছে। ঋণগ্রহীতাদের সঙ্গে সুদে ব্যবসায়ীদের কোনো ধরনের ঝামেলা হলে গ্রামের মেম্বার ও একশ্রেণীর মাতবর মিলে মধ্যস্থতা করে ও মাসিক লভ্যাংশের বিনিময়ে সমস্যার সমাধান করে দেন এবং তারাই মূলত ব্যক্তিস্বার্থে এই ব্যবসাটি টিকিয়ে রাখছেন। কয়েকটি কেস স্টাডির দিকে নজর দেয়া যাক: কেস স্টাডি ১: সনজিৎ মাস্টার, পিতা শান্তিরাম বিশ্বাস, গ্রাম লক্ষীপুর বছর দেড়েক আগে ৭ লাখ টাকা সুদে ধার নিয়েছিল জাগলা গ্রামের উজ্জল, আরজ ও তারেকের কাছ থেকে । এ পর্যন্ত জমিজমা ও গয়না বিক্রি করে ৫০ লক্ষ টাকা পরিশোধ করলেও চক্র সুদের ফাঁদে এখনও আসল শোধ হয়নি। সনজিৎ মাস্টার খাজুরার বন্দবিলা বিজয় কৃষ্ণ রায় মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক, খুব সাদামাটা জীবনে অভ্যস্ত, সুদখোরদের হতে কয়েকবার শারীরিকভাবে নির্যাতিত হয়েছেন সম্মানের ভয়ে মুখ ফুটে কাউকে বলেননি, আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলেন কয়েকবার। তার এই সুদের টাকার কারনে আজ ৩ টি পরিবার সব কিছু বিক্রি করে রিক্ত নিঃস্ব হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে। শেষ পর্যন্ত এলাকাছাড়া হতে হয়েছে সনজিৎ মাস্টারকে। সনজিৎ মাস্টার আজও নিখোঁজ। আর এ দিকে অল্পদিনেই আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়েছে সুদখোরেরা। এখন ভয় দেখাচ্ছে তার মামার জমির ধান কেটে নেবে বলে। গোটা পরিবার এখন চোখে মুখে অন্ধকার দেখছে। কেস স্টাডি ২: নৃপেন ডাক্তার, গ্রাম: নিধীপুর, নেহায়েৎ বিপদে পড়ে এক লক্ষ টাকা ধার নিয়েছিলেন মাসিক ৪০ হাজার টাকা সুদে। করোনা প্রাদুর্ভাব সহ বিভিন্ন সমস্যার কারণে সুদের কয়েকটা কিস্তি আটকে যায়, আর তাতেই সুদ আসল মিলিয়ে দাড়ায় ৩৫ লক্ষ টাকা। কয়েক দফা নৃপেন ডাক্তারকে মারধর করা হয়, সুদখোরদের চাপে তিনি ভিটেমাটি বিক্রি করে দিতে বাধ্য হন, তাতেও চক্র ঋণের হাত থেকে তিনি বাঁচতে পারেননি। শেষ পর্যন্ত পুরো পরিবারসহ তিনি এখন নিরুদ্দেশ। কেস স্টাডি ৩: ইব্রাহিম মোল্লা, গ্রাম জাগলা দক্ষিণপাড়া, তার স্ত্রীর সিজার অপারেশনের জন্য মাগুরা সদর হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন, ভর্তি হওয়ার সাথে সাথে মাগুরা সদর হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ (বিশেষভাবে অজ্ঞ) ডাক্তার তাকে ফরিদপুর হাসপাতালে রেফার্ড করে। এমতাবস্থায় অবস্থায় কোনো উপায়ান্তর না দেখে সুদে ২০ হাজার টাকা ধার নেন পাশের বাড়ির সাবিনার কাছ থেকে। বিগত দেড় বছরে তিনি ৫৬ হাজার টাকা পরিশোধ করলেও আসলের খাতায় কিছুই জমা পড়েনি, সব নাকি সুদের ঘরে জমা হয়েছে। তারপর সুদখোর সাবিনা লোকজন এনে ইব্রাহিম মোল্লাকে সপরিবারে বেদম মারধর করে। তার ছোট মেয়েটি বুকে আঘাত পেয়ে মাগুরা সদর হাসপাতালে ভর্তি। একথা সত্য যে মানুষ বাধ্য হয়ে ও বিপদে পড়ে সুদে কারবারিদের কাছ থেকে চড়া সুদে ঋণ নিচ্ছে। সাময়িক কিছুটা লাভ হলেও প্রকারান্তরে যে বিরাট একটা চক্রের মধ্যে জড়িয়ে যাচ্ছেন এটা অনেকেই প্রাথমিক অবস্থায় টের পান না। জাগলা গ্রামের প্রধান সুদখোরদের তালিকায় আছেন উজ্জ্বল, আরজ আলী, আক্তার, আবুয়াল, আজিজুর এবং আসবা গ্রামের সুজন। এদিকে আমাদের অনুসন্ধানী রিপোর্ট সংগ্রহকালে জাগলা গ্রামের মেম্বার রবিউল ফোন করে প্রধান এই সুদখোরদের নাম সংবাদপত্রে প্রকাশ না করতে অনুরোধ জানান। তিনি দাবি করেন মাগুরার ডিবি পুলিশের তৎপরতায় এরা এখন ভালো হয়ে গেছেন, খোঁজ নিয়ে দেখা যায় গোপনে তারা সুদে ব্যবসা অব্যাহত রেখেছেন। গ্রামের সুদখোর ও ঋণগ্রহীতাদের মাধ্যে সমস্যা দেখা দিলে মহিলা মেম্বারের স্বামী আবুয়াল, আক্তার, আজিজুর এরা নিজেরাই বিচার আচার করে থাকেন। অনুসন্ধানে দেখা গেল শুধু প্রয়োজনেই নয় এখানকার কিছু মানুষ জুয়ায় আসক্ত তারা বিভিন্ন সময়ে সুদে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে থাকেন। নিধি পুর বটতলা, আঙ্গরদাহ খালপাড়ের বাগান, চাপড়া শ্মশান ঘাটসহ প্রভৃতি স্থানে দিনদুপুরে ব্যাপকভাবে জুয়া খেলা হয়। সুদখোররা সব সময় জুয়াড়িদের টার্গেট করে ঋণ দিয়ে থাকে, জাগলা বাজারে পুলিশের টহল থাকলেও জুয়া খেলার বিরুদ্ধে কোন ধরনের ব্যবস্থা নেয়ার কথা শোনা যায় না। উপরোক্ত ঘটনার আলোকে জাগলা এইচ এম হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক আব্দুর রাজ্জাক মন্ডল ক্ষোভ প্রকাশ করেন এবং তিনি জানান এই প্রত্যন্ত‌ অঞ্চল ক্রমশই ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, প্রতিনিয়তই দেখা যাচ্ছে সামাজিক বিশৃঙ্খলা, সুদখোরদের সুদের টাকা পরিশোধ না করতে পেরে অনেকে চুরি ডাকাতি শুরু করছে, আজ একজনের গরু চুরি হচ্ছে, কাল একজনের ফসল চুরি হচ্ছে, পরশু কারো ঘরের জানালা দিয়ে বউয়ের গহনা চুরি হচ্ছে, আবার এমনও ঘটনা ঘটে কেউ বউ বন্ধক রেখে জুয়া খেলছে। এখনই যদি ব্যবস্থা না নেয়া হয় তাহলে এই অঞ্চলে সাধারণের বসবাসের অনুপযুক্ত হয়ে পড়বে। কিভাবে এই সুদের ব্যবসা বন্ধ করা সম্ভব? প্রথমত জুয়া খেলা বন্ধ করতে হবে, দ্বিতীয়তঃ এনজিওগুলোকে সহজ শর্তে ঋণ প্রদান করতে হবে, তৃতীয়তঃ জনসচেতন বৃদ্ধি করতে হবে, চতুর্থত: সুদে কারবারিদের সামাজিকভাবে বয়কট ও প্রশাসনের কঠোরতা

ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category