শ্রমজীবি মানুষের বক্ষে পা ফেলেই পৃথিবীতে এসেছে সব নব উত্থান। আমার বিলাশবহুল জীবন,সুউচ্চ ইমারত,উন্নত যান,মোটর কলকারখানা সবইতাদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফল।তারা না থাকলে আৃরা এত আরামের জীবন উপভোগ করতে পারতাম না।এ মানুষগুলো অক্লান্ত পরিশ্রম করে ঠিকই তবে সবসময় তারা ন্যায্য পারিশ্রমিক বা ন্যূনতম সম্মান ও পায় না আমাদের কাছ থেকে।একসময় তারা লড়েছিল তাদের অধিকারের জন্য।বিশ্ববাসীকে বুঝিয়ে দিয়ছিল তারা ছাড়া সমাজ অচল।
১৮৮৬ সালের এক মে সারা আমেরিকায় একযোগে শ্রমিকরা ধর্মঘটের ডাক দিয়েছিল তাদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের দাবিতে। সেই ধর্মঘটে যোগ দিয়েছিল হাজার হাজার শ্রমিক। রেলির স্লোগান ছিল আট ঘন্টার ঘন্টার শ্রম,আট ঘন্টার ঘুম,আট ঘন্টার বিনোদন। এর আগে ১৮২০ সাল থেকে ১৮৪০ সাল পর্যন্ত শ্রমিকরা আন্দোলন করেছিলেন দশ ঘন্টা কাজের দাবিতে।
এরপর ১৮৮১ সালে নভেম্বরে প্রতিষ্ঠা করা হয় আমেরিকান ফেডারেশন অব লেবার।এরই ধারাবাহিকতায় অক্টোবরে চতুর্থ সম্মেলনে গৃহীত হল ১৮৮৬ থেকে ১ মে থেকে আট ঘন্টা কর্মঘণ্টা নির্ধারিত হবে বলে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
তবে পৃথিবীর কোন অধিকার আদায়ের আন্দোলন এত সহজে কার্যকর হয়নি।এর পিছনের ইতিহাস ছিল আত্মত্যাগের, সংগ্রামের। ১৮৮৬ সালের ৩ মে শ্রমিকরা তাদের আন্দলনের দিক নির্ধারনের সিধান্ত গ্রহন করবে বলে ঠিক করেছিল।
ওই দিন আন্দোলনকারীদের সঙ্গে কারখানার মালিকদের সংঘর্ষ হয়। এতে ঘটনাস্থলে চারজন শ্রমিক মারা যান। এতে ক্ষুদ্ধ শ্রমিক নেতারা ৪ মে জোরালো আন্দোলনের ডাক দেয়।
এই দিন তিন হাজারের মতো শ্রমিক শিকাগোর হে মার্কেট স্কোয়ারে আন্দোলনে যোগ দেন। আন্দোলন চলাকালীন সময়ে বিকেলে শেষের দিকে পুলিশ শ্রমিকদের উপর গুলি চালায়।
এতে অনেক শ্রমিক নিহত হয়। শেষ পর্যন্ত এই আন্দোলন দাঙ্গায় রূপ নেয়। এই সময় পুলিশ আটজন নেতাকে গ্রেফতার করে। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয় হত্যা, দাঙ্গা সৃষ্টি করার।
শুরু হয় ঐতিহাসিক বিচারকার্য নেতাদের বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ উত্থাপন করতে না পারলেও বিচারক এদের সবাইকে প্রাণদণ্ডের আদেশ দেন। ১৮৮৭ সালে ১১ নভেম্বর অগাস্ট স্পাইস এ্যালবার্ট পারসন, এ্যাডলফ ফিশার ও এনগেলকে প্রাণদণ্ড দেয়া হয়।
দুইস লিংগ বন্দি অবস্থাতেই আত্মহত্যা করেন। প্রতিবাদের ঝড় উঠল। এরপর এই আন্দোলন শুধু আমেরিকার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে নি, ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বের অন্যান্য দেশেও। তারই ধারাবাহিকতায় ১৮৮৯ সালের জুলাই মাসে ফ্রান্সের প্যারিসে আয়োজন করা হয় আন্তর্জাতিক শ্রমিক কংগ্রেসের।
এখানেই সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় আগামী বছর (১৮৯০ খ্রিস্টাব্দ) ১ মে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস পালন করা হবে। প্রতিবছর শ্রমিকশ্রেণীর আন্তর্জাতিক সংহতি, সৌভ্রাত্র ও সংগ্রামের দিন বলে ঘোষিত হল ১ মে।
এভাবেই ১৮৮৬ সালের ঐতিহাসিক মে দিবস রূপান্তরিত হয় ১৮৯০ সালের আন্তর্জাতিক মে দিবসে। প্যারিস সম্মেলনে ঘোষণার পর থেকেই দেশে দেশে মে দিবস পালিত হয়।
১৮৯০ সালে গ্রেট ব্রিটেনে ১ মে’র পরিবর্তে ৪ মে হাইড পার্কে লক্ষ লক্ষ মানুষের উপস্থিতিতে প্রথম আন্তর্জাতিক মে-দিবস উদ্যাপিত হয়। সারা বিশ্বের মেহনতী মানুষের শ্রমের ক্ষেত্রে ন্যায্য মজুরি ও দৈনিক আট ঘণ্টা কাজের দাবিতে ১৮৮৬ সালের ১ মে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো নগরীতে যে আন্দোলন হয় ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে তা আজ বিশেষভাবে স্মরণীয়।
দৈনিক আট ঘণ্টা কাজের ব্যবস্থাপনা এখন প্রায় সবদেশেই প্রতিষ্ঠিত। মে দিবস তাই দুনিয়ার মেহনতি মানুষের সঙ্কল্প গ্রহণের দিন। এই সঙ্কল্প হল সামাজিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে শ্রেণিবৈষম্যের বিলোপসাধন।
পুঁজিবাদী দাসত্বশৃঙ্খল থেকে মুক্তির দৃঢ় অঙ্গীকার। মে দিবস শ্রমিকশ্রেণীর চিন্তা-চেতনায় এনেছে এক বৈপ্লবিক তাৎপর্য। লেনিন মে দিবসকে ব্যবহার করেছিলেন শ্রমিকশ্রেণীর বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানের বলিষ্ঠ হাতিয়ার হিসেবে।
তারই সার্থক পরিণতি ১৯১৭ সালের নভেম্বর বিপ্লবে। মে দিবস দুনিয়া জুড়ে শ্রমিক আন্দোলন ও মুক্তি সংগ্রামের ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ। সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধচক্রান্তের তীব্র প্রতিবাদ, দুনিয়ার শ্রমিক এক হওয়ার উজ্জীবন মন্ত্র।
১৯৮৬ সালে ঐতিহাসিক মে দিবসের শতবর্ষ শেষ হয়েছে। মে দিবসের এই দীর্ঘ শতবর্ষের আলোয় অনেক অন্ধকার দূর হয়েছে। সংগ্রামী শ্রেণির সামনে উন্মোচিত হয়েছে নতুন দিগন্ত। দৃঢ় হয়েছে শ্রমিক সংহতি। বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ মানুষ আজ রয়েছে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায়।
কিন্তু এখনও জনসংখ্যার বৃহৎ অংশ পুঁজিবাদী দাসত্ব থেকে মুক্ত নয়। মুক্ত নয় সামন্ততান্ত্রিক শোষণ থেকে। সাম্রাজ্যবাদী শক্তি আজও প্রবল, পরাক্রান্ত। এখনও তার নির্লজ্জ রণ-হুংকার থামে নি।
তাই দুনিয়া জুড়ে মে দিবসের যে বিজয় অভিযান সেখানে মূর্ত হয়ে উঠেছে সমাজতন্ত্রের সপক্ষে ও পুঁজিবাদ ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে শ্রমিকশ্রেণীর বৈপ্লবিক সংগ্রাম।
এই সংগ্রামী চেতনা ও চরিত্রই শ্রমজীবীর ভূষণ। মে দিবস আজ আর শ্রমিকের কাজের ঘণ্টা কমানোর দাবির আন্দোলন নয়। মে দিবস আজ দুনিয়ার মেহনতি মানুষের সংগ্রামের দিন, সৌভ্রাতৃত্বের দিন।
Leave a Reply