শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪, ০২:২৫ অপরাহ্ন
শিরোনাম :

অসাম্প্রদায়িক,অকৃতদার এক ত্রিকালদর্শী বিপ্লবীর নাম ফণীভূষণ মজুমদার

লেখকঃ এড. গৌরাঙ্গ বসু
  • Update Time : বৃহস্পতিবার, ২৯ এপ্রিল, ২০২১
  • ২২৪ Time View
ত্রিকালদর্শী বিপ্লবীর নাম ফণীভূষণ মজুমদার

ব্রিটিশ ভারতে জন্ম ক্ষ্ণজন্মা এ নক্ষত্রের জন্ম সাল
১৯০১।যিনি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি অম্বিকাচরণ
মজুমদারের ভ্রাতুষ্পুত্র সতীশ চন্দ্র মজুমদারের
পুত্র।উত্তরাধিকার সূত্রে তিনি জমিদার পরিবারের সন্তান
।তদকালীন মহাকুমা শহর মাদারীপুরের কুমার নদী বিধৌত তীরবর্তী
অঞ্চল সেন্দিয়া গ্রাম তাঁর জন্মস্থান। শৈশব কেটেছে তাঁর
মাদারীপুরে।
অগ্নিযুগের বিপ্লবী ফণীভূষণ মজুমদার পারিবারিকভাবেই
রাজনৈতিক পরিমন্ডলে বেড়ে উঠেছিলেন।শিশুকাল হতেই বিপ্লবী
চেতনা,দেশাত্মবোধ ও জনসেবামুলক কর্মকান্ডে উজ্জ্বীবিত ছিল
ত্রিকালদর্শী এই অকুতোভয় বিপ্লবীর জীবন।
মাদারীপুর উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয় থেকে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক,
পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে আই এস সি ও

কোলকাতা বিদ্যাসাগর কলেজ থেকে বিএ পাস করেন।তিনি
কলকাতার রিপন কলেজে আইন বিষয়ে পড়াশুনা করেন।তিনি রাজশাহী
কলেজে বিএ শ্রেণিতে অধ্যয়ণ করেছিলেন।ছাত্রাবস্থাতেই তিনি
রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন। ১৯১৯ সালে মাত্র ১৮ বছর
বয়সে বিখ্যাত বিপ্লবী পূর্ণ চন্দ্র দাসের ভাবশিষ্য হিসেবে গুপ্ত
সমিতিতে যোগদানের মধ্য দিয়ে ফণীভূষণ মজুমদারের রাজনীতিতে
হাতে খড়ি ।
সেই যে দীক্ষিত হয়েছিলেন আর ঘরে ফেরা হয়নি।বাঁধা হয়নি ঘর
সংসার।অকৃতদার থেকেছেন আজীবন। ১৯৮১ সালের ৩১ অক্টোবর
পর্যন্ত আমৃত্যু রাজনীতি, দেশ ও জনগনের নিঃস্বার্থ সেবায়
নিমগ্ন ছিলেন নিরহংকার এ অগ্নিপুরুষ।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ৭০ এর
নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানে বাংগালীদের নিরংকুশ বিজয় হলেও
পাকিস্তানিরা ক্ষমতা হস্তান্তরে গড়িমসি শুরু করলে বঙ্গবন্ধু
প্রথমে অসহযোগ আন্দোলন এবং পরবর্তীকালে স্বাধীনতার
ঘোষণা ও মুক্তিযুদ্ধের ডাক দিলে ফণীভূষণ মজুমদার বাংলাদেশ ও
ভারতে অবস্থানরত তাঁর বিপ্লবী সহকর্মীদের মুক্তিযুদ্ধের জন্য
সংগঠিত করেন।পূর্ব বাংলায় অবস্থানরত সহকর্মীদের সংগঠিত
করে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য ভারতে গমন করেন।তাঁর উদ্যোগে
আওয়ামীলীগের কতিপয় শীর্ষ নেতৃত্বের সাথে আলোচনা করে
ভারতীয় কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সর্বাত্মক সহায়তা
দানের বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
মুক্তিযোদ্ধাদের ভারত কর্তৃক সামরিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা
করার ব্যাপারে তিনি সর্বাধিক ভূমিকা পালন করেন।ভারত

সরকারের দেওয়া প্রথম অস্ত্রের চালানটি তাঁর মাধ্যমে হস্তান্তর
করা হয়।ফণীভূষণ মজুমদার মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক হিসেবে
অনবদ্য ভূমিকা রাখেন।মুজিব নগর সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে
তিনি গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করেছেন।মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা
কমিটির সদস্য ,দক্ষিণ-পশ্চিম আঞ্চলিক কাউন্সিলের( যশোর-
ফরিদপুর) চেয়ারম্যান এবং সেই সময়ে ভারতে আশ্রিত ১১ টি
শরনার্থী শিবির ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন এই
প্রবাদ পুরুষ।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিজয় লাভের পর
পরই ফণীভূষণ সরাসরি ঢাকায় চলে আসেন। ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধুর
মন্ত্রী সভায় বঙ্গবন্ধু ফণীভূষণ মজুমদারকে খাদ্য ও বেসামরিক
পরিবহন মন্ত্রনালয়ের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব প্রদান করেন।দেশ
গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করেন নিবেদিত প্রাণ এই মহান মানুষটি।
১৯৭৩ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের প্রথম নির্বাচনে
তিনি আওয়ামীলীগের প্রার্থী হিসেবে ফরিদপুর -১৯ (রাজৈর) আসন
থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে প্রথমে বঙ্গবন্ধু মন্ত্রী সভার
খাদ্য ও বেসামরিক পরিবহন মন্ত্রনালয় এবং পরে ভূমি প্রশাসন ও
ভূমি সংস্কার মন্ত্রনালয়ের দায়িত্ব লাভ করেন।এ সময় তিনি
অস্ট্রেলিয়া,কানাড়া,যুক্তরাজ্য,যুক্তরাষ্ট্র,জাপান প্রভৃতি বন্ধু
দেশ ভ্রমণ করে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের জন্য খাদ্য-সামগ্রী
সংগ্রহার্থে বিভিন্ন দেশের সাথে সহযোগিতা্মুলক চুক্তি স্বাক্ষর
করেন। ১৯৭৪ সালে ষড়যন্ত্রমূলক ও কৃত্রিমভাবে সৃষ্ট দূর্ভিক্ষ
মোকাবিলায় সততা ও নিষ্ঠার সংগে দায়িত্ব পালনে তিনি দিনরাত
অক্লান্ত পরিশ্রম করেন।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পরবর্তী ৮১ দিন মন্ত্রী থাকা
অবস্থাতেও ফণীভূষণ মজুমদারকে খুনিচক্র সার্বক্ষনিক কড়া
নজরে রাখতেন। তবু তিনি মূষড়ে পড়া আওয়ামীলীগ ও এর সহযোগী
সংগঠনের নেতা-কর্মীদের সংগঠিত করতে থাকেন।তাঁর সরকারি
বাসভবনে এসব নেতা-কর্মীকে তিনি নানা কৌশলে মিলিত হওয়ার
সুযোগ করে দিয়েছেন।সামরিক স্বৈরাচারের নজরদারি ,নানা প্রকার
হুমকি -ধমকি ও হয়রানি বেড়ে যায়।তিনি এসব উপেক্ষা করে এবং
গোয়েন্দাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে আওয়ামীলীগ ও এর সহযোগী
সংগঠনের সস্বস্ত্র আত্মগোপনে চলে যাওয়া ও বঙ্গবন্ধু হত্যার
প্রতিবাদকারী নেতা-কর্মীদের সংগে যোগাযোগ স্থাপন
করেন।এভাবেই মুজিব বলয়ের নেতা-কর্মীরা দুর্দিনে সবচেয়ে
নির্ভরযোগ্য আশ্রয়স্থল হিসেবে তাঁর ছত্রছায়ায় সংগঠিত হতে
থাকেন।
১৯৮০ সালে আওয়ামীলীগের কাউন্সিল অধিবেশনে ফণিভূষণ
মজুমদার সংগঠনের প্রেসিডিয়াম সদস্য নির্বাচিত হন।পরবর্তী
বছর ১৯৮১ সালে তাঁকে আওয়ামীলীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য
নির্বাচিত করা হয়।মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি এ পদেই বহাল ছিলেন।
ব্রিটিশ -ভারত,পাকিস্তান ও বাংলাদেশে পাহাড়সম চড়াই-উতরাই
পেরিয়ে অবর্ণ্নীয় ঝুঁকি নিয়ে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত রাজনৈতিক
অংগনে অমিতবিক্রমে দৃঢ় চিত্তে পদচারণা করেছেন বিপ্লবী
কর্মবীর ,নির্ভীক রাজনীতিক ফণীভূষণ মজুমদার।জ । জীবনের
প্রায় ৩০ বছর জেলে কাটিয়েছেন।ভারতীয় উপমহাদেশের আর কোন
রাজনৈতিক নেতা এত বছর জেল খাটেননি। সমগ্র ভারতীয়
উপমহাদেশের একজন বিখ্যাত ও বিদগ্ধ রাজনৈতিক নেতা ও

জমিদার পরিবারের সন্তান হয়েও তাঁর মধ্যে ছিলনা কোন অংবোধ বা
রাজনৈতিক আভিজাত্য। বরং চলন- বলন, পোষাক- পরিচ্ছদ ও
আচার-ব্যবহারে তিনি ছিলেন একেবারেই অনন্য সাধারণ ও মার্জিত
স্বভাবের একজন।তিনি ছিলেন সহনশীলতার উত্তম
আদর্শ।প্রচলিত রীতি-নীতি,সময়ানুবর্তিতা,সততা ও
কর্মনিষ্ঠা,কর্তব্যপরায়ণতা,স্বমত ও ভিন্নমতের রাজনৈতিক
নেতাকর্মীদের প্রতি তিনি ছিলেন অতি মানবীয় ও কমনীয় স্বভাবের
একজন মানুষ। নেতা-কর্মীদের প্রতি সহমর্মিতা, সাধারণ ও খেটে
খাওয়া মানুষ জাতি- ধর্ম, বর্ণ,সম্প্রদায় নির্বিশেষে সব মানুষের
প্রতি তাঁর ভালোবাসা ছিল অকৃত্রিম ও অনুকরণীয়।
আজন্মলালিত রাজনৈতিক আদর্শের বাতাবরণে আবৃত এ মানুষটির
অন্তকরণে ছিল সাধারণ মানুষের জন্য কান্নার বলিরেখা।
সবকিছুতেই তিনি ছিলেন অনন্য সাধারণ।নির্লোভ,নিরহংকারী ও
নির্মোহ বিপ্লবী অগ্নিপুরুষ ফণীভূষণ মজুমদারের আদর্শ বর্তমান
রাজনৈতিক অংগনে বড় বেশী প্রয়োজন।
আজকের এই ক্ষয়িষ্ণু রাজনৈতিক অংগনে ঘুনে ধরা সমাজকে
আলোকিত করতে মুজিবাদর্শের স্বপ্নে বিভোর বিপ্লবী ফণীভূষণ
মজুমদারের মত অকুতোভয় বীর বিপ্লবী অগ্নি পুরুষের আদর্শ
অনুসরণ অত্যাবশ্যক। তাহলেই দেশ সকল নীচুতা –
হীনতা,সাম্প্রদায়িকতা,জাত-পাত,ধর্মান্ধতার নাগপাশ থেকে মুক্ত
হয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্ভাসিত হয়ে বঙ্গবন্ধুর সোনার
বাংলায় পরিনত হবে।
এড গৌরাঙ্গ বসু- লেখক,শিক্ষক,সাংবাদিক,আইনজ্ঞ ও
মানবাধিকার কর্মী।

লেখকঃ এড. গৌরাঙ্গ বসু

ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category