বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ০২:৪৫ অপরাহ্ন

শিক্ষকদের চোখে দুঃস্বপ্ন,জীবিকার তাগিদে কেউ শ্রমিক কেউবা দিনমজুর!

মো.রেজাউল করিম
  • Update Time : শনিবার, ১৯ জুন, ২০২১
  • ২২০ Time View

পেকুয়া স্কুলের ক্লাসরুমে ব্ল্যাকবোর্ডে চক-ডাস্টার দিয়ে শিক্ষার্থীদের জীবন গড়তে যে শিক্ষকদের ব্যস্ত সময় পার করার কথা ছিল, চিরায়ত সে দৃশ্য আমূল পাল্টে সব কিছু ওলটপালট করে দিয়েছে করোনাভাইরাস নামের অদৃশ্য মহামারি। এরই ব্যতিক্রম নয় কক্সবাজারের পেকুয়ায় অবস্থিত বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকবৃন্দ। সরকারি প্রতিষ্ঠান গুলো বন্ধ থাককেও অনবরত চলছে তাদের বেতন ও ভাতা। অন্যদিকে হাজারো দুঃস্বপ্ন নিয়ে দিন কাটছে নন-এমপিও ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা। নাম না বলার শর্তে অনেক শিক্ষকরা বলেন,আমরা বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে ২/৩ হাজার টাকা বেতন পাই। সেই ফাঁকে টিউশন থেকে আসে অল্প পুঁজি। যা দিয়ে কোনমতে অর্ধাহারে চলতো আমাদের সংসার। আমাদের মধ্যে অনেকেই ভাড়া বাড়িতে থাকেন, বিশেষ করে তাঁদের অবস্থা আরো ভয়াবহ। সম্প্রতি করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়াতে বন্ধ হয়ে যায় আমাদের কাঙ্ক্ষিত অর্থ উপার্জনের পথ। আমাদের একটাই দাবি অবিলম্বে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া হউক। দীর্ঘ ১৫ মাস ধরে অব্যাহত থাকা এই মহামারির কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় নন-এমপিও ও বেসরকারি শিক্ষকরা কর্মহীন হয়ে জীবন-জীবিকার সন্ধানে বেছে নিতে বাধ্য হয়েছেন বিচিত্র পেশা। এই ১৫ মাসে তাঁদের চশমায় জমেছে স্বপ্নের পরিবর্তে দুঃস্বপ্ন। কলমে জমেছে মরিচা। বিদ্যালয়ের প্রিয় প্রাঙ্গণ তাঁদের খুব করে টানলেও জীবিকার টানে তাঁরা হাঁটছেন অচেনা পথে। শিক্ষকতার মহান পেশা ছেড়ে বেঁচে থাকার সংগ্রামে বাধ্য হচ্ছেন এমন সব পেশা বেছে নিতে, যা কখনো তাঁরা কল্পনাও করেননি। শিক্ষার্থীদের জীবন গড়ার এসব কারিগরের কারো হাতে এখন মোটরবাইকের চাবি, অনেকে করছেন রংমিস্ত্রির কাজ আবার কেউবা শ্রমিক-দিনমজুর। কেউ রাস্তায় ফেরি করে বিক্রি করছেন ওষুধ। আবার বিদ্যালয়ে শিশু-কিশোরদের কলকাকলির মধ্যে শিক্ষাদানে অভ্যস্ত কোনো শিক্ষক জীবন বাঁচাতে খুলে বসেছেন চাল-ডালের মুদি দোকান। এমনকি জীবনসংগ্রামে বাধ্য হয়ে একটু রোজগারের জন্য কেউ কেউ দিনমজুর পর্যন্ত খাটছেন। এভাবে চাপা কষ্ট বুকে নিয়ে কোনোমতে বেঁচেবর্তে আছেন নন-এমপিও এবং বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কয়েক লাখ শিক্ষক/ শিক্ষিকা। করোনা মহামারির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গিয়ে পুরো বিশ্বই এখন স্থবির। ব্যতিক্রম নয় বাংলাদেশেও। শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় দেশজুড়ে লকডাউন শুরুর আগেই গত বছরের ১৭ই মার্চ থেকে বন্ধ করে দেওয়া হয় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। তখন থেকেই মূলত নন-এমপিও এবং বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের জীবনে নেমে আসতে শুরু করে অমানিশার অন্ধকার। সরকারি ও এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা কোনোমতে টিকে থাকলেও বেকায়দায় পড়ে যান নন-এমপিও এবং বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা। আবার করোনা সংক্রমণ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বন্ধ হতে থাকে একের পর এক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও। এতে এসব প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তারা পড়েন বিপাকে। অনেকে সঞ্চয় ভেঙে কিছুদিন প্রতিষ্ঠানের ব্যয় নির্বাহ করেছেন। কিন্তু দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় তাঁদের সে প্রচেষ্টাও বেশি দিন টিকিয়ে রাখা যায়নি। সাধারণ শিক্ষক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কর্ণধার, বেশ কিছু শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এমনিতেই নন-এমপিও শিক্ষকরা সামান্য বেতন পান। এসব শিক্ষকের সংসার চলত টিউশনির আয় থেকে। কিন্তু ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে করোনা সংক্রমণ সে পথও বন্ধ করে দিয়েছে। সব কিছু বন্ধ থাকায় মানসিক এবং মানবিক বিপর্যয় নেমে আসে এসব শিক্ষকদের জীবনে। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে অনেক শিক্ষক চক্ষুলজ্জা ভুলে এমন কিছু পেশায় নিযুক্ত হয়েছেন, জীবনে যা তাঁরা কল্পনাও করেননি। অনেকে আবার কোনো কাজও পাননি। বেকারত্ব তাঁদের জীবনকে করে তুলেছে অভিশপ্ত। শিক্ষকদের এই করুন পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া সহায়তা বিতরণে নয়ছয় হওয়ায় অনেকের কাছে তা পৌঁছায়নি। তালিকায় নাম উঠলেও অনেকে প্রধানমন্ত্রীর অনুদান থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। সর্বশেষ ঘোষণা অনুযায়ী আগামী ৩০ জুন পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে। সম্প্রতি ফের করোনা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা আশঙ্কা করছেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার সম্ভাবনা আরেক দফা মুখ থুবড়ে পড়ল। করোনার তৃতীয় ঢেউ শুরু হলে শিক্ষকদের হতাশাও আরো দীর্ঘ হবে। এর মধ্যেই অন্যান্য প্রায় সব খাত খুলে দেওয়ার কথা তুলে ধরে শিক্ষক নেতারা বলছেন, পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া হোক। একসঙ্গে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা সম্ভব না হলেও ধাপে ধাপে শিডিউল করে শিক্ষাব্যবস্থাকে জাগিয়ে তোলা হউক। তথ্যমতে, বর্তমানে দেশে প্রায় সাড়ে ৯ হাজার নন-এমপিও স্কুল-কলেজ ও মাদরাসায় এক লাখ ১০ হাজার শিক্ষক-কর্মচারী রয়েছেন। এ বছর দুই হাজার ৬১৫টি প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত হওয়ায় এদের মধ্যে ৩০ হাজার শিক্ষক-কর্মচারী সরকারি বেতনের আওতায় এসেছেন। এখনো অনিশ্চয়তায় রয়েছেন ৮০ হাজার শিক্ষক-কর্মচারী। ৩৫২টি নন-এমপিও কলেজের ১০ হাজার শিক্ষকের আর্থিক অবস্থাও শোচনীয়। দুর্বিষহ জীবন যাপন করছেন ইবতেদায়ি মাদরাসার শিক্ষকরাও। দেশে এমন চার হাজার ৩১২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ২১ হাজার শিক্ষক আছেন। এর মধ্যে মাত্র এক হাজার ৫১৯টি মাদরাসার প্রধান শিক্ষকদের আড়াই হাজার টাকা এবং সহকারী শিক্ষকদের দুই হাজার ৩০০ টাকা ভাতা দেয় সরকার। অন্যদিকে দেশে প্রায় ৬৫ হাজার কিন্ডারগার্টেনে সাত লাখ শিক্ষক রয়েছেন। এসব প্রতিষ্ঠান চলে ভাড়াবাড়িতে। ব্যক্তিমালিকানাধীন এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শতভাগ নির্ভরশীল শিক্ষার্থীদের টিউশন ফির ওপর। টিউশন ফির টাকায় বাড়িভাড়া, নানা ধরনের বিল ও শিক্ষকদের বেতন দেওয়া হয়। তাঁদের সকলের একটাই দাবি, অবিলম্বে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া হউক।

আলোকিত জনপদ .কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category