মাদারীপুরের সমাদ্দারে পাক হানাদার বাহিনীর সাথে সম্মুখ যুদ্ধে ১৯৭১ সালের রনাঙ্গনে ১০-ই ডিসেম্বর সমাদ্দার ব্রীজ সংলগ্ন শত্রুর বুলেটে বিদ্ধ হয়ে শহীদ হন সর্বকনিষ্ঠ মুক্তিযোদ্ধা ছরোয়ার হোসেন বাচ্চু শরীফ। তখন তার বয়স মাত্র ১৩ বছর।
তার বুকের তাঁজা রক্তে লেখা হয় মাদারীপুরের ইতিহাস। ঐ দিন পাক হানাদারের সাথে রক্তক্ষয়ী সম্মুখ যুদ্ধে বিজয় লাভ করে খলিল বাহিনী। শত্রুমুক্ত হয় মাদারীপুর জেলা। তখন বাঙালীর বিজয়ের বাকি ছিলো মাত্র ৫ দিন। পাক হানাদার বাহিনীকে পরাস্থ করে এই জেলা থেকে শত্রুদের চিরতরে বিতারিত করে মুক্তিযুদ্ধের সূর্য সন্তানেরা।
স্বাধীন হয়, মুক্ত হয় জিম্মি হয়ে থাকা এই দক্ষিনের দ্বার মাদারীপুরের আলো-বাতাস, রাস্তা-ঘাট, লোকালয়-জনপদ। আজ ১১ই ফেব্রুয়ারী (রবিবার) দুপুরে তার বাড়ির উঠনে এই স্বরণ সভার আয়োজন করা হয়। সভায় উপস্থিত হয়ে শাজাহান খান (এমপি) বলেন, সে দৃশ্য আমার এখনও মনে আছে।
সে গ্রেনেড নিক্ষেপ করতে গিয়ে গুলিতে আহত হয় এবং শহীদ হয়। তিনি আরও বলেন, সরোয়ার বয়সে সবার ছোট হলেও ও ছিলো দূর্দান্ত সাহসী যোদ্ধা। বারংবার নিষেধ করলেও তাকে কখনও নিবৃত করতে পারি নি। যখন যেখানে বলতাম, সেখানেই সরোয়ার চলে যেত। অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ নিলেও গ্রেনেড হামলায় তার ছিল বেশি আগ্রহ। সরোয়ার তার সঙ্গে গ্রেনেড রাখত।
গ্রেনেড দিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের ওপর কয়েকটি সফল হামলা চালায় সে। মাদারীপুর হানাদারমুক্ত হওয়ার কিছুক্ষণ আগে সরোয়ারকে হারিয়েছি আমরা। মুক্তিযুদ্ধে তার অবদান ও সাহসিকতা স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখার মতো। মুক্তিযুদ্ধের যে চেতনা, তা ভুলে গেলে শহীদদের প্রতি অমর্যাদা করা হবে। ৩০ লক্ষ শহীদের প্রানের বিনিময়ে একটি মানচিত্র পেয়েছি। স্বাধীন বাংলাদেশ পেয়েছি।
এখনও মুক্তিযুদ্ধের কিছু বিরোধী শক্তি এই দেশ ও দেশের মানুষকে নিয়ে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। কিন্তু যারা এই দেশকে সত্যিই ভালোবেসেছে, তারা তাদের বুকের তাঁজা রক্ত দেশের স্বাধীনতার জন্য উৎসর্গ করেছে। দেশকে যারা ভালোবাসে, তারা তাদের সবচাইতে দামি জীবন দিয়ে হলেও মাতৃভূমিকে রক্ষা করে।
জীবনের বিনিময়ে কেনা এই স্বাধীনতা বাঙালীর ইতিহাসে ও হৃদয়ে হাস্যজ্জ্বল এক অম্লান ইতিহাস। জেলার সর্বকনিষ্ঠ যোদ্ধা সরোয়ারকে সমাহিত করা হয় মাদারীপুর সরকারী কলেজের প্রধান ফটকের পাশে। সমাধিস্থলে বসানো নামফলকে শহীদ সরোয়ারের নাম, ঠিকানা লেখা রয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি মাদারীপুরে এসেছিলেন।
ঐ দিন স্বহস্থে এই বীর যোদ্ধার ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন। খলিল বাহিনীর প্রধান খলিলুর রহমান খান বলেন, ৯ ডিসেম্বর ভোর ৫টায় হানাদার বাহিনী গোলবারুদ, অস্ত্র ও কনভয়সহ তাদের বাঙালি দোসর রাজাকার, আলবদর, আলসামস ও মুজাহিদ বাহিনী নিয়ে ফরিদপুরের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। ভোর সাড়ে ৫টার দিকে ঘটকচর সেতু পার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ শুরু করে।
৯ ডিসেম্বর সারাদিন সারারাত এবং ১০ ডিসেম্বর সারা দিন সম্মুখ যুদ্ধ চলে মুক্তিযোদ্ধা ও হানাদার বাহিনীর মধ্যে। তুমুল যুদ্ধের এক পর্যায়ে হানাদার বাহিনীর গোলা-বারুদ শেষ হয়ে আসলে ১০ ডিসেম্বর দুপুরের পর মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষ থেকে হ্যান্ডমাইকযোগে পাকিস্তানি বাহিনীকে আত্মসর্পণের আহ্বান জানানো হয়।
এতে সাড়া দিয়ে হানাদার বাহিনী রাইফেলের মাথায় সাদা কাপড় উড়িয়ে বাঙ্কার থেকে বেরিয়ে আসে এবং কৌশলে পাশের খাল থেকে পানি, গাড়ি থেকে শুকনো খাবার ও গোলা-বারুদ নিয়ে পুনরায় বাঙ্কারে ঢুকে গুলিবর্ষণ শুরু করে। এই যুদ্ধে নেতৃত্ব দেয় খলিল বাহিনী। যুদ্ধে শহীদ হন মাদারীপুরের সর্ব কনিষ্ঠ মুক্তিযোদ্ধা সরোয়ার হোসেন বাচ্চু। দুঃসাহসিক এই ক্ষুদে মুক্তিযোদ্ধা শত্রুর ব্যাঙ্কারে গ্রেনেড চার্জ করে ক্রোলিং করে ফিরে আসার সময় ক্রস ফায়ারে শহীদ হন।
যুদ্ধে ২০ হানাদার সেনা নিহত হয়। তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলা হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধের মুখে ১০ ডিসেম্বর সন্ধ্যার আগেই হানাদার বাহিনীর মেজর আবদুল হামিদ খটক এবং ১৪ রাজাকারসহ ৫৩ জনের একটি দল নিয়ে খলিল বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেন।
মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পাক বাহিনীর আত্মসমর্পণ করলে শত্রুমুক্ত হয় মাদারীপুর। এ সংবাদ জেলার বিভিন্ন স্থানে পৌঁছালে হাজার হাজার মুক্তিকামী মানুষ জয়বাংলা স্লোগান দিয়ে রাস্তায় নেমে আসে। আনন্দ-উল্লাসে ফেটে পড়ে মুক্তিকামী সাধারণ জনতা। সভায় উপস্থিত ছিলেন আরও অনেক বীর মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরিবার বর্গসহ গন্যমান্য আরও অনেকে।
Leave a Reply