দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) উপ-পরিচালক মাহবুবুল আলম ওরফে ‘ভাগিনা মাহবুব’-ঘুস- দুর্নীতির মাধ্যমে প্রায় ৫শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। এ বিষয়ে একাধিক গণমাধ্যমে সচিত্র সংবাদ প্রকাশিত হলেও দুদক কমিশন তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নেওয়ায় জাতীয় দৈনিক পত্রিকার একজন সাংবাদিক গত ২৬/০৮/২০২৫ তারিখে প্রায় ১০ টি দৈনিক পত্রিকার পেপারকার্টিং সংযুক্ত করে দুদক চেয়ারম্যান বরাবরে একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন। অভিযোগপত্রে তিনি উপ-পরিচালক মাহবুবের অবৈধ পথে অর্জিত সম্পদের অনুন্ধানে তদন্ত টিম গঠনের অনুরোধ জানান।
তদপ্রেক্ষিতে গত ৪ সেপ্টেম্বর দুদক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল মোমেন স্বাক্ষরিত একখানা প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। প্রজ্ঞাপনে বলা হয় যে, সম্প্রতি বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদনে মাহবুবুল আলমের বিরুদ্ধে মামলার ভয় দেখিয়ে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া, তদন্ত কার্য থেকে দায়মুক্তির বিনিময়ে আইডিয়াল স্কুলের প্রিন্সিপাল ও প্রশাসনিক কর্মকর্তার কাছ থেকে কোটি টাকা গ্রহণ, এসেন্সিয়াল ড্রাগসের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কাছ থেকে ১০ কোটি টাকা নেওয়া এবং নিজ নামে, স্ত্রী ও মায়ের নামে জমি ও বিপুল সম্পদ অর্জনের অভিযোগ ওঠে। অভিযোগ অনুযায়ী, শুধু ঢাকার গুলশান, বসুন্ধরা, জোয়ার সাহারা, ডেমরা এবং জামালপুরের সরিষাবাড়িতে তার প্রায় ৫শত কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে । প্রজ্ঞাপনে আরও বলা হয়, গত ২৭ আগস্ট দুদকের ২০/২০২৫ নম্বর কমিশন সভায় অভিযোগের গুরুত্ব ও রাষ্ট্রীয় স্বার্থ বিবেচনায় নিয়ে তাকে সাময়িক বরখাস্তের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। দুর্নীতি দমন কমিশন (কর্মচারী) চাকরি বিধিমালা, ২০০৮-এর ৪৩(১) বিধি অনুযায়ী বরখাস্তকালীন মাহবুবুল আলম খোরাকি ভাতা পাবেন বলে উল্লেখ করা হয়।
তদন্ত কর্মকর্তা নিযুক্ত হন দুদক প্রধান কার্যালয়ের পরিচালক মন্জুর মোর্শেদ। তিনি প্রায় ৪ মাস যাবত অভিযোগটি তদন্ত করেন। তদন্তকালে তিনি সংবাদে উল্লেখিত ঘুস দেওয়া প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিগনের কাছ থেকে ঘুস নিয়েছেন কিনা কেবলমাত্র সেটির অনুসন্ধান করেই তদন্ত কাজ সমাপ্ত করে সাময়িক বরখাস্তে থাকা উপ পরিচালক মাহবুব আলমের পক্ষে তদন্ত রিপোর্ট জমা দিয়েছেন মর্মে দুদকের একটি নির্ভরযোগ্য সুত্র নিশ্চিত করেছে। আর এই তদন্ত রিপোর্টের ভিত্তিতে উপ-পরিচালক মাহবুবকে সাময়িক বরখাস্ত আদেশ প্রত্যাহার করে চাকুরীতে পূর্নবহালের চেষ্টা করা হচ্ছে। আর তাদের জবানবন্দীকে উপজীব্য করেই উপ-পরিচালক মাহবুবকে নির্দোষ হিসাবে প্রমাণ করার প্রয়াস চালিয়েছেন তদন্তকারী কর্মকর্তা পরিচালক মঞ্জুর মোর্শেদ। আর এই ক্ষেত্রে প্রায় ১ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে বলে গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে।
বিশ্বস্থ সূত্রে জানা গেছে, মাহবুবুল আলম শুরুতে দুদকের একজন পিয়ন ছিলেন। ধীরে ধীরে তিনি নিজের ক্ষমতা বাড়িয়ে় গুরুত্বপূর্ণ মামলার তদন্তের দায়ি়ত্ব নেন এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ভয় দেখিয়ে অর্থ আদায় করেন। তার নামে সোনালী ব্যাংকের মহাখালী শাখায়় কয়ে়কটি লকারে প্রায় ৩০-৪০ কোটি টাকা নগদ ও বিপুল পরিমান স্বর্ণ থাকার তথ্য পাওয়া গেছে। এ ছাড়া ঢাকার বিভিন্ন অভিজাত এলাকায়় তার নামে প্রায় ১৫০ কোটি টাকার সম্পত্তি রয়ে়ছে। জামালপুরের শরীষাবাড়ীতে মাহবুবের প্রভাব এতটাই যে, তার অনুমতি ছাড়া কেউ জমি ক্রয়়-বিক্রয়় করতে পারে না। স্থানীয়রা তাকে ‘অঘোষিত সম্রাট’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। অভিযোগ রয়েছে, তিনি প্রভাবশালী মহলের ছত্রছায়ায় থেকে শত শত বিঘা জমি ক্রয় করেছেন। তদন্তের নামে হয়রানি এবং মোটা অঙ্কের অর্থ আদায় অভিযোগে ঢাকা আইডিয়াল স্কুলের সাবেক অধ্যক্ষ সাহানা বেগম ও প্রশাসনিক কর্মকর্তা আতিকসহ অনেকেই ভুক্তভোগী। এছাড়া এসেনশিয়াল ড্রাগস কোম্পানির এমডি অধ্যাপক এহসানুল কবিরের বিরুদ্ধে তদন্তের নামে ১০ কোটি টাকা গ্রহণের অভিযোগ রয়েছে।
সবচেয়ে বিতর্কিত অভিযোগ হলো, ঢাকার নন্দীপাড়া এলাকায়় তিন বিঘা জায়গার ওপর তার একটি বাগান বাড়ি ও ‘হেরেমখানা’ তৈরি করেছেন। যেখানে নিয়়মিত অনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালিত হয় বলে স্থানীয়রা অভিযোগ করেছেন। দুদকের মতো সংস্থার একজন কর্মকর্তা কীভাবে এত বিপুল সম্পদের মালিক হলেন এবং এতদিন ধরে ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেলেন, তা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন উঠেছিল। আর সেই প্রশ্নের নিরসনেই তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয় এবং ঘুস-দুর্নীতি করেছেন কি না সেটি তদন্ত করতে বলা হয়। এখন দেখা যাচ্ছে শস্যের মধ্যেই ভুত রয়েছে। অর্থাত; যাকে তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়েছে তিনি নিজেই শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা করছেন। আমাদের প্রশ্ন হলো: উপ-পরিচালক মাহবুব যদি ঘুস দুর্নীতি নাই করে থাকেন তবে তিনি তার স্ত্রী,মা এবং সন্তানদের নামে এই বিপুল পরিমাণ সম্পদ কিভাবে পেলেন? প্রায় ৫ শত কোটি টাকা মূল্যের এই সম্পদের ছবি ও ভিডিও আমাদের দপ্তরে সংরক্ষিত রয়েছে।
এ বিষয়ে এ প্রতিবেদক তদন্তকারী কর্মকর্তা পরিচালক মঞ্জুর মোর্শেদকে প্রথম দিন প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, আমাকে কেবল তিনি ওই সব প্রতিষ্ঠান থেকে ঘুস নিয়েছেন কি না এটি তদন্ত করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তার অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধানে কমিশন থেকে আরেকটি তদন্ত টিমকে দায়িত্ব দেওয়া হতে পারে। কিন্ত গত ২০ ডিসেম্বর ২০২৫ তারিখ থেকে অদ্য ২৩ ডিসেম্বর ২০২৫ তারিখ পর্যন্ত তাকে একাধিকবার ফোন দিলেও তিনি কল রিসিভ করেননি। এতেই প্রমাণিত হয় যে, “ডাল মে কুছ কালা হায়”।
এ বিষয়ে দুদকে অভিযোগকারী সাংবাদিক সোহেল রানা বলেন, শস্যের মধ্যে ভুত থাকলে সেই ভুত আর তাড়াবে কে? তবে দুদক যদি এই উপ-পরিচালক মাহবুব এর সম্পদের অনুসন্ধান বা তদন্ত না করে ছাড় দেয় বা তার সাময়িক বরখাস্ত আদেশ প্রত্যাহার করে তবে তিনি হাইকোর্টের দ্বারস্থ হবেন।
মন্তব্য করুন