
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে ২৩৭টি আসনে দলীয় প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করেছে। ঘোষিত তালিকার শীর্ষে রয়েছেন দলটির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া, যিনি দীর্ঘদিন ধরেই অসুস্থ ও চিকিৎসাধীন অবস্থায় আছেন।
দলীয় ঘোষণায় জানানো হয়েছে, খালেদা জিয়া বগুড়া-৭, দিনাজপুর-৩ ও ফেনী-১ আসন থেকে প্রার্থী হচ্ছেন। অপরদিকে, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বগুড়া-৬ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন।
তবে নির্বাচনী প্রচারে নেতৃত্ব দেবেন কে, আর জয়ের পর সরকার গঠিত হলে প্রধানমন্ত্রী হবেন কে— সে বিষয়ে বিএনপি আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানায়নি। এ কারণেই প্রচারে দলের নেতৃত্ব কে দেবেন, তা নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে নানা প্রশ্ন উঠেছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, খালেদা জিয়ার অসুস্থতা এবং তারেক রহমানের দেশে ফেরা অনিশ্চিত থাকায় বিএনপি কৌশলগতভাবে এই প্রার্থী তালিকা তৈরি করেছে। দলের ধারণা, নির্বাচনে জয়ী হলে সরকার গঠনে নেতৃত্ব দেবেন তারেক রহমানই।
স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, “আমরা আশা করি দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে আবারও নেতৃত্ব দেবেন। নির্বাচনে মাঠে নেতৃত্ব দেবেন তারেক রহমান। বর্তমান বাস্তবতায় তাকেই আমরা ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ভাবছি।”
প্রসঙ্গত, বর্তমানে ব্রিটেনে রাজনৈতিক আশ্রয়ে থাকা তারেক রহমান দেশে তার বিরুদ্ধে থাকা সব মামলায় অব্যাহতি পেয়েছেন।
খালেদা জিয়া প্রথমবার নির্বাচনে অংশ নেন ১৯৯১ সালে। তার জ্যেষ্ঠ পুত্র তারেক রহমান এবারই প্রথম সংসদ নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন, যদিও ২০০৮ সালের ২২ জানুয়ারির নির্বাচনের জন্য তিনি প্রার্থী হয়েছিলেন, কিন্তু সেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি।
২০০১ সালের বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের সময় খালেদা জিয়া তারেক রহমানকে সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব করেন— যা অনেকের মতে, তাকে ভবিষ্যৎ নেতা হিসেবে গড়ে তোলার সূচনা ছিল।
২০০৭ সালে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে মা-ছেলে দুজনই গ্রেপ্তার হন। ১৮ মাস কারাভোগের পর ২০০৮ সালে মুক্তি পেয়ে চিকিৎসার জন্য লন্ডনে যান তারেক রহমান। পরে তিনি সেখানেই রাজনৈতিক আশ্রয় নেন এবং ধীরে ধীরে লন্ডন থেকেই দলের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে থাকেন।
২০১৮ সালে খালেদা জিয়া কারাদণ্ডপ্রাপ্ত হওয়ার পর বিএনপির নেতৃত্ব কার্যত তারেক রহমানের হাতে চলে যায়। তিনি লন্ডন থেকে দলের সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা করছেন, এবং নেতাকর্মীদের কাছেও এখন মুখ্য নেতৃত্ব হিসেবে স্বীকৃত।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট খালেদা জিয়া নির্বাহী আদেশে মুক্তি পাওয়ার পর চিকিৎসার জন্য লন্ডনে গেলে সাত বছর পর মা-ছেলের পুনর্মিলন হয়। তবে দলের দৈনন্দিন কার্যক্রম এখনো তারেক রহমানের হাতেই রয়েছে।
বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, খালেদা জিয়ার প্রার্থী হওয়া নিয়ে দলটির ভেতরেও অনিশ্চয়তা ছিল। অনেকের ধারণা ছিল, প্রতীকীভাবে তিনি একটি আসনে লড়বেন, আর মূলত একাধিক আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন তারেক রহমান। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখা যায়, খালেদা জিয়া তিনটি আসনে, আর তারেক রহমান একটি আসনে প্রার্থী হয়েছেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. কাজী মারুফুল ইসলাম মনে করেন, “খালেদা জিয়াকে তিনটি আসনে প্রার্থী করা বিএনপির নির্বাচনী কৌশলের অংশ। এতে বোঝানো হয়েছে, তিনি এখনো সক্রিয় এবং দলটির শীর্ষ নেতৃত্বে আছেন।”
তিনি আরও বলেন, “এই পদক্ষেপের মাধ্যমে বিএনপি একধরনের বার্তা দিয়েছে যে নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিয়ে তাদের কোনো দ্বিধা নেই, বরং তারা খালেদা জিয়ার জনপ্রিয়তা ও ভাবমূর্তি কাজে লাগাতে চাইছে।”
লেখক ও বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমেদও একই মত পোষণ করেন। তাঁর মতে, “তারেক রহমানের দেশে ফেরা নিয়ে অনিশ্চয়তা থেকেই গেছে। তাই খালেদা জিয়াকে তিনটি আসনে মনোনয়ন দিয়ে বিএনপি বুঝিয়ে দিয়েছে— দলীয় নেতৃত্ব এখনো তাঁর হাতেই।”
তিনি বলেন, “নির্বাচনে ও সরকারে নেতৃত্ব কে দেবেন, বিএনপি তা এখনো স্পষ্ট করেনি। সম্ভবত খালেদা জিয়া থাকবেন দলনেতা হিসেবে, আর সরকার গঠিত হলে নেতৃত্ব দেবেন তারেক রহমান।”
তবে সবকিছুই স্পষ্ট হবে তারেক রহমান দেশে ফেরার পর— কিন্তু কবে তিনি ফিরবেন, সে বিষয়ে এখনো কোনো নির্দিষ্ট ঘোষণা দেয়নি বিএনপি।
সূত্র: বিবিসি বাংলা