ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে পাড়ি: বাংলাদেশিদের সংখ্যা শীর্ষে
সাগরপথে ইউরোপে প্রবেশের ক্ষেত্রে এখন শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসেই প্রায় ৯ হাজার ৭৩৫ জন বাংলাদেশি ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালিতে প্রবেশ করেছেন। বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের তথ্য অনুযায়ী, গত এক দশকে অন্তত ৭০ হাজার বাংলাদেশি এই ঝুঁকিপূর্ণ পথে ইউরোপে পৌঁছেছেন।
এই যাত্রাপথে লিবিয়ার বিভিন্ন ক্যাম্পে বহু বাংলাদেশি আটক হয়ে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। তাদের জিম্মি করে পরিবারের কাছ থেকে আদায় করা হয়েছে মোটা অঙ্কের অর্থ। প্রাণহানির ঘটনাও ঘটছে নিয়মিত। তবুও ইউরোপে পৌঁছানোর স্বপ্নে বাংলাদেশিদের এই অনিয়মিত অভিবাসন থামছে না।
ব্র্যাক জানায়, যারা এই পথে ইউরোপে যাচ্ছেন তাদের বেশিরভাগের বয়স ২৫ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে। মাদারীপুর, শরীয়তপুর, সিলেট, সুনামগঞ্জসহ দেশের অন্তত ১০-১২টি জেলা থেকে লোকজন মরিয়া হয়ে পড়ছে এই ঝুঁকিপূর্ণ অভিবাসনে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, বিশেষ করে ফেসবুক গ্রুপের মাধ্যমে এই পাচার প্রক্রিয়া পরিচালিত হচ্ছে। প্রতারণার শিকার অনেকেই দেশে ফিরে মামলা করলেও মূল দালালরা ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মানবপাচার সম্পর্কিত প্রতিবেদনে জানা যায়, ২০২৪ সালেই মানবপাচার আইনে নতুন করে এক হাজার ৩৪টি মামলা হয়েছে। বিচারাধীন রয়েছে প্রায় সাড়ে চার হাজার মামলা, যার মধ্যে তিন হাজার মামলার বিচার এখনো শেষ হয়নি এবং এক হাজারের বেশি মামলার তদন্ত এখনও চলছে।
এই প্রেক্ষাপটে ৩০ জুলাই পালিত হবে আন্তর্জাতিক মানব পাচার বিরোধী দিবস। জাতিসংঘ ২০১৩ সালের ১৮ ডিসেম্বর ৩০ জুলাইকে মানব পাচার দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। এ বছরের প্রতিপাদ্য— ‘সংঘবদ্ধ অপরাধ মানবপাচার, বন্ধ হোক শোষণের অনাচার’।
ব্র্যাকের সহযোগী পরিচালক শরিফুল হাসান বলেন, "গত কয়েক বছর ধরেই ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালিতে যাওয়ার প্রবণতায় বাংলাদেশিদের সংখ্যা শীর্ষে। এই যাত্রায় বহু মানুষ নিখোঁজ হচ্ছেন, প্রাণ হারাচ্ছেন। লিবিয়ায় গিয়ে ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। পরিবারগুলো অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে ভেঙে পড়ছে। এটি শ্রম অভিবাসনের আড়ালে একটি ভয়াবহ মানবপাচার চক্র।"
তিনি আরও জানান, পাচারকারীরা প্রযুক্তি ব্যবহার করে ক্রমেই আরও চতুর হচ্ছে, কিন্তু আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো সে তুলনায় পিছিয়ে। মামলা হলেও বিচার না হওয়ায় অপরাধীরা উৎসাহ পাচ্ছে।
ফ্রন্টেক্স (ইউরোপীয় সীমান্ত সংস্থা)-এর তথ্য বলছে, ২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে সেন্ট্রাল মেডিটেরিয়ান রুট দিয়ে প্রায় ৯২ হাজার ৪২৭ জন বাংলাদেশি ইউরোপে প্রবেশ করেছেন। এই রুটে প্রায়শই নৌকাডুবি এবং প্রাণহানির ঘটনা ঘটে।
২০২৫ সালের জানুয়ারিতে লিবিয়ায় ২৩ জন বাংলাদেশির গলিত মৃতদেহ উদ্ধার হয়। তারা ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন।
ব্র্যাকের এক গবেষণায় দেখা যায়, এই অভিবাসনপ্রত্যাশীদের ৬০ শতাংশ স্থানীয় দালালদের প্রলোভনে পড়ে যাত্রা শুরু করেন, কিন্তু ৮৯ শতাংশই ইউরোপে গিয়ে কোনো চাকরি বা উপার্জনের সুযোগ পাননি। বরং তারা নানা ধরনের ঝুঁকি ও নির্যাতনের মধ্যে পড়েছেন।
সাধারণত ঢাকা থেকে দুবাই-মিসর হয়ে লিবিয়া, কিংবা ইস্তামবুল-দুবাই, কাতার অথবা সিরিয়া হয়ে লিবিয়ায় পৌঁছান এসব যাত্রী। এই যাত্রাপথে ৬৩ শতাংশ মানুষ বন্দি হয়েছেন, যাদের ৯৩ শতাংশকেই ক্যাম্পে আটকে রাখা হয়। বন্দিদের মধ্যে ৭৯ শতাংশ শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন এবং ৬৮ শতাংশই চলাফেরার স্বাধীনতা হারান। এমনকি তিন বেলা খাবার না পাওয়ার কথাও জানিয়েছেন বহুজন।
২০১২ সালে মানবপাচার প্রতিরোধে আইন পাশ হলেও মামলার বিচার প্রক্রিয়া অত্যন্ত ধীরগতির। অধিকাংশ মামলা এখনও ঝুলে আছে, আর যে ক’টির রায় হয়েছে, সেখানেও আসামিরা বেশিরভাগ সময় খালাস পাচ্ছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হালনাগাদ তথ্যমতে, ২০২৫ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত ৪ হাজার ৩৬০টি মানবপাচার মামলা এখনও নিষ্পত্তিহীন। এর মধ্যে ১ হাজার ৩৪৬টি মামলা তদন্তাধীন এবং তিন হাজার ১৪টি মামলা বিচারাধীন অবস্থায় রয়েছে।
সম্পাদক
এড. গৌরাঙ্গ বসু (ট্রিপল এম.এ)
প্রকাশক
সবুজ বালা
© ২০২৫ আলোকিত জনপদ কর্তৃক সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত