বাংলাদেশ ও ভারতে অঙ্গ পাচার ও অবৈধ ব্যবসার খবর নিয়মিতই আসে। বিশেষ করে কিডনি পাচার এই বাণিজ্যের অন্যতম বড় অংশ। প্রতারণার সুযোগ নিয়ে দালালরা বাংলাদেশের দারিদ্র্য জনগোষ্ঠী ও ভারতে কিডনি প্রতিস্থাপনের বেড়ে চলা চাহিদাকে কাজে লাগিয়ে একটি বড় সিন্ডিকেটের ব্যবসায় পরিণত করেছেন। শুক্রবার (৪ জুলাই) আল জাজিরার প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এই চাঞ্চল্যকর তথ্য।
জয়পুরহাট জেলার কালাই উপজেলার বাইগুনি গ্রামের ৪৫ বছর বয়সী সফিরুদ্দিন ২০২৪ সালে পরিবারের আর্থিক অভাব মেটাতে এবং তিন সন্তানের জন্য ঘর নির্মাণের উদ্দেশ্যে নিজের একটি কিডনি ভারতের এক ব্যক্তির কাছে বিক্রি করেন। তার বিনিময়ে সাড়ে তিন লাখ টাকা পান, তবে সেই টাকা ইতিমধ্যে শেষ। পেটের ডান পাশে হালকা চাপ দিলেই এখনো তীব্র ব্যথা অনুভব করেন, আর অস্ত্রোপচারের চিহ্ন শরীরে বহন করছেন।
বর্তমানে সফিরুদ্দিন জয়পুরহাটের একটি হিমাগারে দিনমজুর হিসেবে কাজ করছেন। অস্ত্রোপচারের পর দুর্বল শরীর নিয়ে তার জন্য প্রতিদিনের পরিশ্রম কঠিন হয়ে পড়েছে। তিনি বলেন, “সব করেছি আমার স্ত্রী ও সন্তানদের জন্য।”
শুরুতে ভয় থাকলেও, দালালদের আশ্বাসে ধীরে ধীরে রাজি হন তিনি। পাসপোর্ট, ভিসা, বিমানযাত্রাসহ হাসপাতালের যাবতীয় কাগজপত্র দালালরা পুরোপুরি প্রস্তুত করে দেয়। ভারতে মেডিকেল ভিসায় যেতেও তার হাসপাতালের কাগজপত্রে ‘রোগীর আত্মীয়’ হিসেবে দেখানো হয়। জাল পরিচয়পত্র, ভুয়া জন্মনিবন্ধন ও নোটারি সনদপত্রও তার জন্য তৈরি করা হয়। কিন্তু সফিরুদ্দিন আজও জানেন না তার কিডনি কে পেয়েছে।
ভারতের আইন অনুযায়ী, কিডনি প্রতিস্থাপন অনুমোদিত শুধুমাত্র নিকটাত্মীয়দের মধ্যে, তবে সরকারের বিশেষ অনুমোদনে আত্মীয় না হলেও দান সম্ভব। কিন্তু এই নিয়ম ফাঁকি দিয়ে দালালরা ভুয়া পারিবারিক সম্পর্ক তৈরি করে অবৈধ প্রতিস্থাপনের সুযোগ করে দেয়।
কালাইয়ের বাইগুনি গ্রামে সফিরুদ্দিন ছাড়া প্রায় ৬,০০০ মানুষ এক কিডনি বিক্রি করেছেন। এত বেশি বিক্রির কারণে এ গ্রাম ‘এক কিডনির গ্রাম’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।
২০২৩ সালে ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নাল গ্লোবাল হেলথে প্রকাশিত গবেষণা অনুসারে কালাইয়ে প্রতি ৩৫ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মধ্যে একজন কিডনি বিক্রি করেছেন। অধিকাংশ বিক্রেতা ৩০-৪০ বছর বয়সী, যাদের বেশিরভাগই চরম দারিদ্র্য, ঋণ, মাদকাসক্তি বা জুয়ায় বাধ্য হয়ে এই পথ বেছে নিয়েছেন।
অপারেশনের পর দালালরা সফিরুদ্দিনের পাসপোর্ট ও প্রেসক্রিপশনসহ কোনো কাগজপত্র ফেরত দেয়নি, প্রয়োজনীয় ওষুধও জুটেনি। চিকিৎসা বা পর্যবেক্ষণ ছাড়াই তাকে বাড়ি পাঠিয়ে দেয়া হয়। অনেক সময় দালালরা বিক্রেতাদের কাগজপত্র নিজেদের কাছে রেখে নষ্ট করে দেয়, যাতে তারা পরবর্তীতে কোনো দাবি বা আইনি পদক্ষেপ নিতে না পারে।
এই অঙ্গগুলো মূলত ভারতের ধনী কিডনি রোগীদের কাছে বিক্রি হয়, যারা বৈধ প্রক্রিয়ার দীর্ঘ অপেক্ষা এড়িয়ে দ্রুত সমাধান চান। ভারতে প্রতিবছর প্রায় দুই লাখ মানুষ চূড়ান্ত কিডনি রোগে আক্রান্ত হলেও ২০২৩ সালে মাত্র ১৩,৬০০টি কিডনি প্রতিস্থাপন হয়েছে। এ চাহিদা ও সরবরাহের ফাঁক থেকেই গোপন বাজার ও দালালচক্র সক্রিয়।
অনেক সময় বিক্রেতারা তাদের পুরো অর্থও পান না। যেমন মোহাম্মদ সাজল (ছদ্মনাম), যিনি ২০২২ সালে দিল্লির একটি হাসপাতালে ১০ লাখ টাকায় কিডনি বিক্রি করেন, কিন্তু পেয়েছেন মাত্র সাড়ে তিন লাখ টাকা। প্রতারিত হয়ে তিনি দালালচক্রের সঙ্গে যুক্ত হয়ে কিডনি বিক্রেতাদের ভারতে পাঠানোর কাজ শুরু করেন। পরে টাকার ভাগাভাগিতে দ্বন্দ্বে চক্র থেকে সরে আসেন এবং এখন ঢাকায় রাইড শেয়ারিং চালক হিসেবে জীবিকা নির্বাহ করছেন।
২০১৯ সালে ভারতের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কিডনি পাচার চক্র নিয়ে তদন্ত শুরু করলে কিছু চিকিৎসক ও হাসপাতালের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। ২০২৪ সালে দিল্লিতে ড. বিজয়া রাজাকুমারি গ্রেপ্তার হন, যিনি ২০২১-২৩ মধ্যে অন্তত ১৫ বাংলাদেশির কিডনি প্রতিস্থাপন করেছিলেন। কিন্তু এসব পদক্ষেপ সীমিত ছিল, ফলে ব্যাপক পরিবর্তন আসেনি।
ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কনসুলার বিভাগের মহাপরিচালক শাহ মুহাম্মদ তানভির মনসুর জানান, এই অবৈধ প্রতিস্থাপনের সঙ্গে জড়িত হাসপাতালগুলোর বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সমন্বিত তথ্য আদান-প্রদানের কোনো ব্যবস্থা নেই। হাসপাতালগুলো কাগজপত্র যাচাই করেই অনুমোদন দেয়ার দাবি করে দোষ এড়ায়।
মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অঙ্গসংগঠন ‘অর্গান ট্রান্সপ্লানটেশন টাস্কফোর্স’-এর সদস্য ড. মনিরুজ্জামান বলেন, প্রতারণার পদ্ধতি প্রায় একইরকম, যেমন নাম পরিবর্তন, ভুয়া নোটারি সনদ, আত্মীয় হিসেবে প্রমাণের জন্য জাল জাতীয় পরিচয়পত্র ইত্যাদি।
ভারতের কিডনি ওয়ারিয়র্স ফাউন্ডেশনের প্রধান বাসুন্ধরা রঘুবংশ বলেন, যদিও আইন আছে, বাস্তবে এটি একটি কালোবাজারে পরিণত হয়েছে। কিডনির চাহিদা থাকায় এই ব্যবসা থেমে না। সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞার পরিবর্তে সুশৃঙ্খল ও মানবিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা জরুরি, যেখানে বিক্রেতাদের জন্য স্বাস্থ্য পরীক্ষা, অস্ত্রোপচারের পর দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা এবং আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে।
আল জাজিরা বাংলাদেশে এক ডজনের বেশি কিডনি দাতার সঙ্গে কথা বলেছে, যাদের সবাই আর্থিক সমস্যার কারণে কিডনি বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন। তারা জানিয়েছে, এই ব্যবসাটি সহজ হলেও অত্যন্ত নিষ্ঠুর।
সীমান্তে কিডনি পাচার ব্যবসার কথা স্বীকার করে বাংলাদেশ পুলিশ জানায়, তারা জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিচ্ছে। সহকারী মহাপরিদর্শক এনামুল হক সাগর জানান, অঙ্গপাচার নেটওয়ার্কগুলো ট্র্যাক করতে গোপন তদন্তকারীরা কাজ করছেন।
ভারতের দিল্লির ডেপুটি পুলিশ কমিশনার অমিত গোয়েল বলেন, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ প্রায়ই জাল কাগজপত্র শনাক্ত করতে ব্যর্থ হয়, ফলে অবৈধ প্রতিস্থাপন সম্ভব হয়।
বাংলাদেশের একাধিক জেলায় কাজ করা দালাল মিজানুর রহমান বলেন, একটি কিডনি প্রতিস্থাপনে মোট খরচ পড়ে ২৫ থেকে ৩৫ লাখ টাকা, কিন্তু বিক্রেতারা পান মাত্র ৩ থেকে ৫ লাখ টাকা। বাকি অর্থ ভাগ হয় দালাল, ভুয়া কাগজপত্র তৈরির কর্মকর্তা, অসাধু চিকিৎসক ও হাসপাতালের সংশ্লিষ্টদের মধ্যে।
তিনি জানান, অনেক সময় সরাসরি কিডনি বিক্রির কথা না বলে ‘ভালো কাজের’ প্রলোভন দেখিয়ে মানুষদের ফাঁদে ফেলা হয়। কেউ কেউ কাজের সন্ধানে ভারতে গিয়ে অপারেশনের শিকার হন, এরপর কোনো সহায়তা না পেয়ে সেখানেই পরিত্যক্ত হয়ে পড়েন।
এক দালাল জানান, প্রতিস্থাপন সহজ করতে হাসপাতালগুলোকে ঘুষ দেওয়া হয়। বাংলাদেশের দালালরা ভারতের প্রতিপক্ষদের সঙ্গে যোগাযোগ করে, যারা ডাক্তারদের নিয়োগ দেন এবং প্রাপ্ত অর্থের বড় অংশ নিয়েই থাকেন।
Leave a Reply