১৯৭০-এর দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে বিশ্বব্যাপী বাণিজ্যে কনটেইনার ব্যবস্থাপনা ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর আমদানি-রপ্তানির পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ায় দ্রুত ও নিরাপদ কার্গো হ্যান্ডলিংয়ের জন্য কনটেইনার ব্যবস্থাপনার প্রয়োজনীয়তা বেড়ে যায়। ১৯৭৭ সালে প্রথম কনটেইনারবাহী জাহাজ এমভি বাঙাল প্রোগ্রেস চট্টগ্রাম বন্দরে এসে পৌঁছায়, যা দেশের ইতিহাসে প্রথমবার কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত হয়।
সেই বছরই ৩৪,০৪৮ টিইইউ কনটেইনার হ্যান্ডলিং করা হয়। এরপর বাংলাদেশ বিশ্ব বাণিজ্যের দরবারে নানাভাবে নিজের অবস্থান শক্ত করেছিল। দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর হিসেবে চট্টগ্রামের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল অপরিসীম। বিভিন্ন সংকট থাকা সত্ত্বেও একযোগে সকলের সহযোগিতায় চট্টগ্রাম বন্দরের কার্যক্রম ধারাবাহিকভাবে এগিয়ে গিয়েছে।
সাম্প্রতিক ২০২৪-২৫ অর্থবছরেও নতুন এক মাইলফলক স্পর্শ করা হয়েছে। ৪৮ বছরের ইতিহাসে সর্বোচ্চ কনটেইনার পরিবহন সম্পন্ন হয়েছে চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে।
বছরজুড়ে বন্দরে মোট ৩২ লাখ ৯৬ হাজার ৬৭টি টিইইউ (২০ ফুট দৈর্ঘ্যের সমতুল্য ইউনিট) কনটেইনার হ্যান্ডলিং হয়েছে, যা আগের অর্থবছরের তুলনায় ১ লাখ ২৭ হাজার ৩৭৭ টিইইউ বেশি। এর আগের অর্থবছরে ৩১ লাখ ৬৮ হাজার ৬৯০ টিইইউ হ্যান্ডলিং করা হয়েছিল, ফলে বৃদ্ধি হয়েছে ৪ শতাংশ।
একই সঙ্গে দেশের সবচেয়ে বড় কাস্টমস স্টেশন চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৭৫ হাজার ৪৩২ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় করেছে। আগের অর্থবছরের রাজস্ব ছিল ৬৮ হাজার ৭৫৫.৭ কোটি টাকা। এতে রাজস্ব আদায়ে ৬ হাজার ৬৭৬.৩ কোটি টাকা বা ৯.৭১ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
চট্টগ্রাম বন্দর চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এস এম মুনিরুজ্জামান জানান, নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও দেশের অর্থনীতির ‘লাইফলাইন’ খ্যাত চট্টগ্রাম বন্দর কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ে অসাধারণ সাফল্য অর্জন করেছে। জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থান, দীর্ঘস্থায়ী বন্যা, দুই ঈদে ছুটি, কাস্টমস কলম বিরতি, সাম্প্রতিক এনবিআর শাটডাউন, পরিবহন ধর্মঘটসহ নানা বাধার কারণে বন্দরের কার্যক্রম প্রায় দুই মাসের মতো বাধাগ্রস্ত হয়। তবুও বন্দরের কর্তৃপক্ষ এসব বাধা উপেক্ষা করে আগের অর্থবছরের চেয়ে বেশি কনটেইনার হ্যান্ডলিং সম্পন্ন করেছে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, ৩০ জুন শেষ হওয়া ২০২৪-২৫ অর্থবছরে আমদানি-রপ্তানি মিলিয়ে মোট ৩২ লাখ ৯৬ হাজার ৬৭ টিইইউ কনটেইনার ওঠানামা হয়েছে, যা আগের অর্থবছরের ৩১ লাখ ৬৮ হাজার ৬৯০ টিইইউ থেকে ৪.০২ শতাংশ বেশি।
অর্থবছর শেষ হবার ১৫ দিন আগে আগের বছরের কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের পরিমাণ ছাড়িয়ে গিয়েছিল চট্টগ্রাম বন্দর। ২০২২-২৩ অর্থবছরে আমদানি-রপ্তানি মিলিয়ে ৩০ লাখ ৭ হাজার ৩৪৪ টিইইউ, আর ২০২১-২২ অর্থবছরে ৩২ লাখ ৫৫ হাজার ৩৫৮ টিইইউ হ্যান্ডলিং হয়েছিল, যা তখন সর্বোচ্চ রেকর্ড ছিল।
চট্টগ্রাম বন্দর সচিব মো. ওমর ফারুক জানান, এ সাফল্যের পেছনে রয়েছে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার সরাসরি নির্দেশনা, মন্ত্রণালয়ের সর্বাত্মক সহযোগিতা, বন্দরের বোর্ড সদস্যদের তদারকি ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অক্লান্ত পরিশ্রম। এছাড়া বন্দরের অটোমেশন সার্ভিস, ই-গেট পাস চালু, কনটেইনার অপারেটিং সিস্টেম আধুনিকায়ন ও অবকাঠামোগত উন্নয়নও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে।
তিনি আরও বলেন, বন্দর ব্যবহারকারীদের সহযোগিতা, দ্রুত কনটেইনার ডেলিভারির প্রবণতা এবং বন্দরের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগের কারণে এ সাফল্য সম্ভব হয়েছে। তবে অর্থবছরের শেষের কয়েক দিন এনবিআরের শাটডাউন না হলে কনটেইনার হ্যান্ডলিং সংখ্যা ৩.৩ মিলিয়নের কাছাকাছি পৌঁছাতে পারতো। এই সাফল্য দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।
লন্ডনভিত্তিক শিপিং প্রকাশনা ‘লয়েড’স লিস্ট’ অনুযায়ী, চট্টগ্রাম বন্দর বর্তমানে বিশ্বের ৬৭তম ব্যস্ততম বন্দর হিসেবে অবস্থান করছে।
বিজিএমইএর পরিচালক রাকিবুল আলম চৌধুরী বলেন, ‘চট্টগ্রাম বন্দর ও কাস্টমস আমাদের অর্থনীতির হৃদপিণ্ড। কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ে প্রবৃদ্ধি মানেই বাণিজ্যের উন্নতি, যা সরাসরি রাজস্বে প্রতিফলিত হয়। এই ধারা অব্যাহত রাখতে বন্দর ও কাস্টমস কার্যক্রমে বাধা সৃষ্টি না করার সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে।’
এদিকে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস রাজস্ব আদায়ে সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা ৮০ হাজার ৪০২ কোটি টাকার তুলনায় ৪ হাজার ৯৭০ কোটি টাকা পিছিয়ে থাকলেও সামগ্রিক আদায় ইতিবাচক ছিল। ২০২২-২৩ অর্থবছরে রাজস্ব আদায় ছিল ৬২ হাজার ৬৫৮ কোটি টাকা।
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের মুখপাত্র ডেপুটি কমিশনার সাইদুল ইসলাম জানান, ‘বছরজুড়ে আমরা নানা চ্যালেঞ্জ যেমন ধর্মঘট, আন্দোলন ও পরিবহন বন্ধের মুখোমুখি হয়েছি। তবু রাজস্ব আদায়ে ইতিবাচক ধারায় ছিলাম। রাজস্ব ফাঁকি রোধে অডিট, ইনভেস্টিগেশন অ্যান্ড রিসার্চ (এআইআর) শাখার মাধ্যমে নজরদারি জোরদার করা হয়েছে। সব বাধা-বিপত্তির মধ্যেও রাজস্ব আদায়ে ধারাবাহিকতা ও প্রশাসনিক শৃঙ্খলা বজায় রাখা সম্ভব হয়েছে।’
সম্পাদক
এড. গৌরাঙ্গ বসু (ট্রিপল এম.এ)
প্রকাশক
সবুজ বালা
© ২০২৫ আলোকিত জনপদ কর্তৃক সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত