শেখ হাসিনা সরকারের সময়কালকে ঘিরে রাজনীতিবিদসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ গুম ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বলে একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। গুম কমিশনের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, এসব ঘটনা রাষ্ট্রীয় একটি গোয়েন্দা সংস্থা এবং নিরাপত্তা বাহিনীর একটি বিশেষ ইউনিটের সহায়তায় সংঘটিত হয়েছে।
প্রতিবেদনে উঠে আসে, ভুক্তভোগীরা শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের ফলে দীর্ঘ সময় ধরে চরম অস্বস্তির মধ্যে ছিলেন। তাদের অনেক সময় প্রয়োজনের তুলনায় কম খাবার দেওয়া হতো, হাতকড়া পরিয়ে চোখ বেঁধে একাকী সেলে রাখা হতো। ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তার সঙ্গে এই বন্দিত্বের নিপীড়ন মিলে তৈরি করত এক ধরনের স্থায়ী মানসিক চাপ।
প্রতিবেদনটি আরও জানায়, গুমের পুরো প্রক্রিয়াটি ভয় ও অপমানের একটি সংস্কৃতি গড়ে তোলে, যেখানে এমনকি শরীরের স্বাভাবিক কার্যক্রমও হয়ে ওঠে নির্যাতনের অংশ।
১-ক। থাকার স্থানের ভয়াবহ ও অমানবিক অবস্থা
গুম কমিশনের প্রতিবেদনে একাধিক ভুক্তভোগীর ভয়ংকর অভিজ্ঞতার বিবরণ উঠে এসেছে। ৪৬ বছর বয়সী এক ব্যক্তি জানান, ২০১৫ সালে তাকে তুলে নিয়ে ৩৯১ দিন নিখোঁজ রাখা হয়।
তিনি বলেন, “ঘুমাতে গেলেই কেউ একজন এসে বলত, ‘এই, ঘুমাচ্ছেন কেন?’ ঘুমাতে দিত না। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে বালিশ-কাঁথা সরিয়ে দিত, শীতে কাঁপতে হতো। মাঝে মাঝে চেয়ার ছাড়াই বসে থাকতে হতো, পায়ের ওপর ভর দিয়ে। হাতকড়া পরে বিছানার পাশে আটকে রাখা হতো—মশা কামড়ালেও মারতে পারতাম না। কষ্ট হতো খুব। এভাবেই শাস্তি দিতো।”
১-খ। গোপনীয়তাহীন, অস্বাস্থ্যকর ও অপমানজনক সেল জীবন
প্রতিবেদন অনুযায়ী, গুম হওয়া ব্যক্তিরা সেলে একেবারে অমানবিক পরিবেশে ছিলেন। পুরুষ ভুক্তভোগীদের ক্ষেত্রে গোপনীয়তার সম্পূর্ণ অভাব ছিল। ছোট ও সংকীর্ণ সেই সেলগুলোতে নিচু বিল্ট-ইন টয়লেট থাকলেও মাঝখানে ছিল না কোনো দেয়াল। ফলে শোয়ার সময় তাদের শরীর প্রায়শই প্যানের ওপর পড়ত। এতে তারা প্রস্রাব-মল ও নোংরার মধ্যে দিন কাটাতে বাধ্য হতেন।
এতে আরও বলা হয়, আরও ভয়াবহ ছিল, এসব সেলে স্থাপন করা সিসিটিভি ক্যামেরা, যা প্রতিটি কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ করত। ফলে ভুক্তভোগীদের সবচেয়ে ব্যক্তিগত মুহূর্তেও, যেমন প্রাকৃতিক কাজের জন্য টয়লেট প্যান ব্যবহারের সময়ও, চরম অপমান ও লজ্জার মধ্যে থাকতে হতো।
১-গ। নারীদের জন্য বিশেষ নির্যাতন
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, নারী ভুক্তভোগীদের জন্য ছিল আলাদা ও ভয়াবহ ধরনের নির্যাতন। ২০১৮ সালে গুম হওয়া এক ২৫ বছর বয়সী তরুণীর বর্ণনায় উঠে এসেছে—
“আমাকে এমনভাবে বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল, যেন কাউকে ক্রুসিফিক্সে টাঙানো হয়। ওরা আমার ওড়না খুলে নিয়েছিল, গায়ে তখন কিছুই ছিল না। মুখ জানালার দিকে থাকায়—পুরুষরাই শুধু আসছিল, যেন আমায় দেখতে ও উপভোগ করতে। শুনছিলাম, তারা হাসাহাসি করে বলছে—‘এমন পর্দা করত, এখন সব পর্দা সরে গেছে।’ আমার তখন পিরিয়ডের সময় হয়নি, কিন্তু নির্যাতনের পর এতটাই অসুস্থ হয়ে পড়ি যে, সঙ্গে সঙ্গেই পিরিয়ড শুরু হয়ে যায়। আমি তখন বলি, ‘প্যাড দরকার’, কিন্তু তারা সেটা নিয়েও হাসাহাসি করে।”
২। নির্মম প্রহারের অভিজ্ঞতা
গুম সংক্রান্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শারীরিক প্রহার ছিল সবচেয়ে প্রচলিত ও নৃশংস নির্যাতনের ধরন। প্রায় প্রতিটি জায়গায়, প্রায় সব ভুক্তভোগীই এ ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন—even যারা অন্য কোনো পদ্ধতিতে নির্যাতিত হননি, তারাও।
২০২৩ সালে গুম হওয়া ৪৭ বছর বয়সী এক ব্যক্তির অভিজ্ঞতা বর্ণনায় উঠে আসে—
“চোখে কখনো গামছা, কখনো জুমার টুপি বেঁধে রাখা হতো। হাত কখনো সামনে, কখনো পেছনে। যখন বেশি মারত, তখন হাত পিছনে বেঁধে রেখে কনুই, হাঁটুতে মোটা লাঠি দিয়ে আঘাত করত। আমি ভেবেছিলাম হাড় ভেঙে যাবে। পরে দেখি, ফুলে ভয়াবহ অবস্থা, কিন্তু হাড় সম্ভবত ভাঙেনি। একপর্যায়ে তারা বলল, ‘তোর হাড় থেকে মাংস আলাদা করে ফেলবো।’”
২-ক-১। স্থায়ী আঘাতের চিহ্নসমূহ
নির্যাতনের ফলে স্থায়ী আঘাতের চিহ্নগুলো ফুটে উঠতো। ২৩ বছর বয়সী এক যুবককে ২০১৭ সালে অপহরণ করা হয়। এরপর থেকে টানা ৭২ দিন চলে নির্মম নির্যাতন। টর্চারের কারণে তার নাভির দুই পাশে আঘাতের চিহ্ন সৃষ্টি হয়।
ভুক্তভোগীর কথায় “…আমার পা বেঁধে উপর দিকে করে ঝুলাইছে। মাথা নিচের দিক, পা উপর দিক দিয়ে। আমার শরীরে কোনো পোশাক রাখে নাই তখন, একেবারে উইদাউট ড্রেস। তারপরে এলোপাতাড়ি আমাকে দুজনে একসঙ্গে পিটাতে থাকে। খুব সম্ভব বেতের লাঠি দিয়ে। পরবর্তীতে আমাকে অসংখ্যবার টর্চার করেছে এবং মারতে মারতে আমার এমন হয়েছে, চোখের কাপড় খুলে গেছে। নাকে-মুখে চড়ানো, থাপড়ানো। ... শুধু পিছে মারছে। ওই সময়ে চামড়া ছিঁড়ে, মানে চামড়া ফেটে রক্ত ঝরে গেছে। ...”
২-ক-২। নির্যাতনের স্থায়ী চিহ্ন
২৫৩ দিন গুম থাকার পর মুক্তি পাওয়া ৪৬ বছর বয়সী এক ব্যক্তি জানান, তাকে টানা প্রায় ২৪ ঘণ্টা নির্যাতন করা হয়েছিল। নির্যাতনকারীরা চার ঘণ্টার পালাক্রমে মারধর চালাতো। এখনও তার শরীরজুড়ে সেই নির্যাতনের স্থায়ী চিহ্ন রয়ে গেছে। তার সঙ্গে বন্দি থাকা একজন প্রত্যক্ষদর্শীও এই ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।
২-খ। ছাদে ঝুলিয়ে নির্যাতন
নির্যাতনের এক ভয়াবহ কৌশল ছিল ছাদের সঙ্গে ঝুলিয়ে মারধর। গুম হওয়া ৪৭ বছর বয়সী একজন বলেন, “... বললো, ‘এভাবে হবে না, লটকা দিতে হবে।’ একজন এএসআই আমার দুই হাতে রশি বেঁধে ফ্যানের হুকের সঙ্গে ঝুলিয়ে দেয়। কেবল পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুল মেঝে ছুঁয়ে থাকত, পুরো শরীর ঝুলন্ত। এখনো হাত তুলতে পারি না, দুই কাঁধে স্থায়ী সমস্যা হয়েছে।”
২-গ। উল্টো করে ঝুলিয়ে নির্যাতন
ভুক্তভোগীদের উল্টো করে ঝুলিয়ে মারধর করা হতো, যা পুলিশের মধ্যে বেশি প্রচলিত ছিল। ২০১৯ সালে ৪২ দিন গুম থাকা এক যুবক বলেন, “... আমার হাঁটুর মাঝে লাঠি ঢুকিয়ে, হাত বাঁধা অবস্থায় আমাকে উঁচু এক স্ট্যান্ডে উল্টো করে ঝুলিয়ে রাখে। পায়ের তালুতে মারধর শুরু করে চিকন লাঠি দিয়ে। তারপর একই প্রশ্ন, ‘নামগুলো বলো, কারা ছিল তোমার সঙ্গে?’”
২-ঘ। নখ উপড়ে ফেলা
নির্যাতনের আরেক পদ্ধতি ছিল নখ তুলে ফেলা। ৫৬ দিন গুম থাকা এক ব্যক্তি বলেন, “... একদিন বেশি নির্যাতন করল। বলল, টাঙিয়ে রাখো। সেলের গ্রিলের সঙ্গে হাতকড়া দিয়ে ঝুলিয়ে রাখে। দীর্ঘ সময় পর নেমে দেখি, আঙুলের নখ উঠেছে পুরোপুরি।”
২-ঙ। নখের নিচে সুচ ঢোকানো
নখের নিচে সুচ ঢুকিয়ে নির্যাতন ছিল একটি সাধারণ কৌশল। ২৭ বছর বয়সী এক যুবক বলেন, “... গ্রিলের সঙ্গে হাতকড়া দিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখত। একদিন আঙুল প্লাস দিয়ে ধরে, টেবিলে রেখে আরেকজন সুচ ঢুকায়। তখন বলল, ‘তুই আব্দুল মুমিন না?’ আমি বলি, ‘না স্যার, আমি হাবিব।’”
২-চ। বাঁশ দিয়ে নির্যাতন (বাঁশ ডলা)
৩৯ দিন গুম থাকা একজন বলেন, “... আমাকে শোয়ানোর পর হাত ও ঘাড়ের নিচে, পায়ের নিচে ও রানের ওপরে বাঁশ দেয়। বলে, ‘বড় স্যার আসতেছেন।’ কিছুক্ষণ পর স্যার এসে বলে, ‘এই উঠো।’ উঠতেই মনে হলো, আমি আর জীবিত নেই। দুই বাহু ও পায়ের মধ্যে মনে হচ্ছিল মাংস ছিঁড়ে যাচ্ছে।”
৩। বৈদ্যুতিক শক
গুম কমিশনের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, নির্যাতনের দ্বিতীয় সর্বাধিক ব্যবহৃত পদ্ধতি ছিল বৈদ্যুতিক শক। যন্ত্রপাতি সহজলভ্য হওয়ার কারণে এটি প্রায় সর্বত্র ব্যবহৃত হতো — এমনকি অপহরণকারীদের যানবাহনেও, যেখানে তা সহজে বহনযোগ্যভাবে প্রয়োগ করা হতো।
৪৬ দিন গুম থাকার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে এক ব্যক্তি বলেন,
“... আমার পায়ে দুইটা ক্লিপ লাগায় দিল। প্রথমবার বৈদ্যুতিক শকের অভিজ্ঞতা — মনে হচ্ছিল, শরীরটা যেন একটুখানি বলের মতো গোল হয়ে যাচ্ছে। আমাকে হয়তো আট-দশবার শক দেওয়া হয়েছিল। প্রতিবার শক তিন থেকে চার সেকেন্ড স্থায়ী হতো। সঙ্গে সঙ্গে পুরো শরীর শক্ত হয়ে যেত, রগগুলো যেন জড়িয়ে ধরত। প্রশ্ন করে শক দিত, আবার প্রশ্ন করত, আবার শক দিত।
পরে চার-পাঁচ জন খুব বেপরোয়াভাবে মারধর শুরু করে। দুই হাত ধরে আমাকে এক ধরনের হুকের সঙ্গে ঝুলিয়ে দিল। মনে হচ্ছিল, কেউ যেন কোনো সুইচ টিপছে, আর আমার শরীরটা অজান্তে উপরে উঠছে। এরপর তারা আমার কাপড় খুলে আমার স্পর্শকাতর অঙ্গদ্বয়ে একই ধরনের ক্লিপ লাগিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ চালিয়ে যায়।
যখনই তারা সুইচ চাপত, মনে হতো ওই অঙ্গদুটো যেন পুড়ে যাচ্ছে। কখনও কখনও আমার মনে হতো, পুড়ে যাওয়া মাংসের গন্ধও টের পাচ্ছি…”
৪। ওয়াটারবোর্ডিং
২০১৭ সালে গুম হওয়া এক যুবকের বর্ণনা:
“… মুখের ওপর গামছা দিয়ে পানি ঢালতে শুরু করে। জগভর্তি পানি ঢালছে… নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল। তারপর গামছা সরিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘বল, কী করছিস?’ আমি বললাম, ‘স্যার, আমি কী বলব? আপনি বলুন, কী জানতে চান? কেন আমাকে ধরে এনেছেন?’ তখন বলে, ‘না, ওকে ছাড়ার দরকার নেই। আবার গামছা দাও, আবার পানি দাও।’ এইভাবে তিন-চারবার পানি ঢালার পর বলল, ‘ওকে নিয়ে রাখো।’”
৫। নির্যাতনে ব্যবহৃত ঘূর্ণায়মান যন্ত্র ও চেয়ার
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, গুম হওয়া ব্যক্তিদের উপর নির্যাতনে ব্যবহৃত হতো বিশেষ ধরনের ঘূর্ণায়মান যন্ত্র। একাধিক ভুক্তভোগীর বিবরণ বিশ্লেষণ করে দুটি ভিন্ন ধরনের যন্ত্রের অস্তিত্ব চিহ্নিত করেছে গুম কমিশন।
৫-ক। ঘূর্ণায়মান চেয়ারের মাধ্যমে নির্যাতন:
২৮ বছর বয়সী এক যুবক বলেন,
“… একটা মেশিনে উঠায়। মাথা, হাত, হাঁটুর মাঝ বরাবর এবং পায়ের নিচে বাঁধে। সোজা দাঁড়ানো অবস্থায় ছিলাম। চালু হওয়ার পর মনে হলো, শরীরের সব হাড় যেন খুলে যাচ্ছে। মেশিনটার সেটিংই এমন যেন এটা যন্ত্রণা দিতেই তৈরি। তারা বলছিল, ‘পিঠ যেন ঠিকমতো ঠেকে থাকে, না হলে সবকিছু ছাড়িয়ে যাবে।’ মেশিনটি ঘোরানো যেত, কখনো উল্টে, আবার কখনো ফ্ল্যাট করে শুইয়ে দেওয়া হতো। এরপর হাঁটুর ওপর আঘাত করে জিজ্ঞেস করে, ‘সরকারের বিরুদ্ধে কী ষড়যন্ত্র করছ?’”
৬। যৌন নির্যাতন
যদিও যৌন নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে, অনেক ভুক্তভোগী লজ্জা ও ভয়ে তা প্রকাশ করতে চাননি, ফলে অনেক ঘটনা নথিভুক্ত করা সম্ভব হয়নি। তবুও, গুম কমিশন এমন একাধিক নির্ভরযোগ্য সাক্ষ্য পেয়েছে যেখানে নির্যাতনের লক্ষ্য ছিল ভুক্তভোগীর যৌনাঙ্গ।
২০১৮ সালে গুম হওয়া এক ব্যক্তির ভাষ্য:
“… একপর্যায়ে তারা আমার অণ্ডকোষে প্রচণ্ড চাপ দেয়। আমার শরীরের সব শক্তি ফুরিয়ে যায়…”
৬-ক। প্রস্রাবের সময় বৈদ্যুতিক শক:
৪৫ দিন গুম থাকা এক তরুণ বলেন,
“… আমার চোখ বাঁধা ছিল। পিটানোর পর আবার জিজ্ঞাসাবাদ। হঠাৎ তারা বলে, ‘এখানে প্রস্রাব কর।’ প্রস্রাব করার সাথে সাথে মনে হলো, যেন আমি পাঁচ ফুট ওপরে উঠে গেলাম—একটি জোরালো বৈদ্যুতিক শক। শরীরের সবচেয়ে সংবেদনশীল স্থানে সেই শক…”
৬-খ। যৌনাঙ্গে বৈদ্যুতিক শক:
২০১৪ সালে গুম হওয়া এক ব্যক্তি বলেন,
“… কিল-ঘুষি মারার পর প্যান্ট খুলে ফেলে। একটি ক্লিপ আমার একটি অণ্ডকোষে লাগায়। ছয়-সাতজন ছিল, আমার চোখ বাঁধা ছিল। এরপর গাড়ির ভেতর দরজা বন্ধ করে ক্লিপ দিয়ে বৈদ্যুতিক শক দিতে শুরু করে। আমি চিৎকার করছি, এমনকি পা ছুঁড়ে সামনের সিটে লাফানোর ফলে পায়ে ছাল উঠে যায়, কিন্তু তবুও সেই ব্যথা কিছুই মনে হয়নি, কারণ বৈদ্যুতিক শকের যন্ত্রণা ছিল অসহনীয়। প্রায় ১৫–২০ মিনিট শক দেয়। পরে, তিন মিনিট ধরে আমি শুধু চিৎকার করছিলাম, শেষ পর্যন্ত তারা মুখ চেপে ধরে থামায়।”
দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব:
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মুক্তির পর নির্যাতিত ব্যক্তিদের মধ্যে তীব্র মানসিক ট্রমার লক্ষণ স্পষ্ট। অনেকের জীবন ও কর্মজীবন ব্যাহত হয়েছে। এদের অনেকেই চিকিৎসা ও মনোস্বাস্থ্য সহায়তা ছাড়া স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারছেন না।
রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, গুমের শিকার ব্যক্তিদের পরিবারকে নিরাপত্তা বাহিনীর দায়ের করা ভুয়া মামলাগুলোর আইনি লড়াইও চালাতে হয়েছে, যার প্রতিটি মামলার পেছনে গড়ে একজনের প্রায় ৭ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে। এসব ঘটনার প্রভাব তাদের পারিবারিক জীবনেও পড়েছে—বিয়ে, সন্তান জন্ম বা লালনপালনের মতো বিষয়গুলো মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অধিকাংশ পরিবারই এই মানসিক ও আর্থিক চাপ সহ্য করতে না পেরে ভেঙে পড়ে, ফলে ভুক্তভোগীরা এক গভীর অনিশ্চয়তা ও সামাজিক প্রান্তিকতার মাঝে আটকে পড়েন।
প্রায় দুই বছর গুম থাকার পর ফিরে আসা এক যুবকের বাবা বলেন,
“...ছেলেটা এতিম, মায় মারা গেছে। পড়াশোনা করত, সব শেষ। ...\[ফিরে আসার পর] ও চুপচাপ বসে থাকত, হঠাৎ রেগে যেত। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে থাপড় মারত। এখন শুধু একা একা হাসে, কিছু বললে ফেনা তোলে, ঠিকভাবে কথা বলে না। আর আগের মতো নেই। ডাক্তার দেখিয়েছি, ওষুধ দেয়, খায় না। বলে শরীর কাঁপে, ঘুমে ধরে। ওষুধ ফেলে দেয়। ডাক্তার বলে, নিয়ম করে ওষুধ খাওয়াতে হবে।
এই হলো অবস্থা। ছেলেকে পেয়েছি—এইটাই বড় কথা। সবাই বলে, ‘যা হইছে হইছে, এখন ভালোভাবে থাকো।’ কিন্তু আমি জানি, কত কিছু সহ্য করে আজ এখানে দাঁড়িয়ে আছি। এখন আর উকিলের কাছেও যাই না—টাকা-পয়সা নেই...”
গুম কমিশনের তথ্যমতে, অধিকাংশ ঘটনাতেই আটকের কোনো আনুষ্ঠানিক নথি রাখা হতো না, ফলে নিরাপত্তা বাহিনীগুলো দায়মুক্তভাবে নির্যাতন চালাতে পারত। জনসমক্ষে হাজির করার আগে নির্যাতনের চিহ্ন লুকাতে অনেক সময় ভুক্তভোগীদের শরীরে ওষুধ বা মলম লাগানো হতো যাতে ক্ষত সহজে বোঝা না যায়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে চিহ্ন মুছে যাওয়ার পরই তাদের মুক্তি দেওয়া হতো।
সম্পাদক
এড. গৌরাঙ্গ বসু (ট্রিপল এম.এ)
প্রকাশক
সবুজ বালা
© ২০২৫ আলোকিত জনপদ কর্তৃক সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত