প্রায় দুই দশক আগের ঘটনা। তখন সত্তরের দশকে মুক্তি পাওয়া ধর্মেন্দ্র ও আশা পারেখ অভিনীত সিনেমা ‘সমাধি’র একটি গান নতুন করে নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। গানের শিরোনাম ছিল ‘কাঁটা লাগা’, যেটি গেয়েছিলেন লতা মঙ্গেশকর। ২০০২ সালে এই গানটির রিমেক মিউজিক ভিডিওতে মডেল হিসেবে অভিনয় করে রাতারাতি খ্যাতি অর্জন করেন ভারতীয় মডেল শেফালি জারিওয়ালা। এটি ছিল সদ্য প্রয়াত এই অভিনেত্রী ও মডেলের প্রথম কাজ।
সেই সময় শেফালির বয়স ছিল মাত্র ১৯ বছর। অভিষেক কাজেই ব্যাপক সাড়া ফেলে দেন তিনি। এরপর মডেলিং, স্টেজ শো এবং অভিনয়ে নিজেকে নিয়মিতভাবে যুক্ত রাখেন।
২০০৪ সালে পরিচালক ডেভিড ধাওয়ানের ‘মুঝসে শাদি কারোগি’ সিনেমায় সালমান খান, অক্ষয় কুমার ও প্রিয়াঙ্কা চোপড়ার সঙ্গে ক্যামিও চরিত্রে অভিনয় করে আবারও আলোচনায় আসেন শেফালি।
‘কাঁটা লাগা’ গান ও সিনেমার সাফল্যের পর ভারতের পাশাপাশি বিদেশের বিভিন্ন স্টেজ শো ও আয়োজনে নিয়মিত ডাক পেতে শুরু করেন শেফালি। অনুষ্ঠানগুলোতে অংশ নিতে দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়াতে হতো তাঁকে। তবে এই ব্যস্ততার মাঝেও সময়ের সঙ্গে নানা প্রতিকূল পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয় তাকে। একপর্যায়ে অভিনয় থেকে কিছুদিনের জন্য বিরতিও নেন। এ সময় তাঁকে নিয়ে গুঞ্জন ওঠে—তিনি কি অভিনয় ও মডেলিং ছেড়ে দিয়েছেন?
এই প্রশ্নের জবাবে এক সাক্ষাৎকারে শেফালি পরিষ্কার জানান, তিনি পেশা থেকে সরে যাননি, বরং ছিলেন শারীরিক অসুস্থতায় ভুগছেন। তাঁর ভাষায়, “প্রায় এক দশক ধরে একটি রোগ নিয়ে বেঁচে থাকা ছিল বিশাল এক চ্যালেঞ্জ। মুড সুইং আর উদ্বেগজনিত সমস্যায় ভুগতাম, যা স্কুলজীবন ও সামাজিক সম্পর্ককে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। সব কিছু ফাঁকা মনে হতো, আত্মবিশ্বাসও ভেঙে পড়েছিল।”
দীর্ঘ সময় ধরে নিজের অসুস্থতার কথা গোপন রাখলেও একসময় তিনি তা নিজেই প্রকাশ্যে আনেন। এক খোলামেলা সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “আমি ১৫ বছর বয়স থেকেই মৃগীরোগে (এপিলেপ্সি) আক্রান্ত। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নতুন নতুন শারীরিক সমস্যাও দেখা দিচ্ছে। হঠাৎ যেকোনো জায়গায়, যেকোনো সময় এই রোগ আমাকে গ্রাস করে। ‘কাঁটা লাগা’-র পর যখন স্টেজ পারফরম্যান্সে ব্যস্ত হয়ে পড়ি, তখন এই রোগ আমাকে আরও বেশি কাবু করে ফেলত।”
শরীরে কীভাবে এই রোগ বাসা বেঁধেছিল, সে বিষয়েও শেফালি গণমাধ্যমে খোলাখুলি কথা বলেছেন। তিনি জানান, শৈশব থেকেই তাঁর ইচ্ছা ছিল অভিনয়ে ক্যারিয়ার গড়ার। ধীরে ধীরে পরিবারকে বোঝাতে সক্ষম হন এবং স্কুল জীবন থেকেই অভিনয়ের প্রস্তুতি শুরু করেন। তবে এই পেশা নিয়ে আগ্রহ থাকলেও, ভবিষ্যৎ ভাবনা ও পড়াশোনার চাপ তাঁকে মানসিকভাবে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত করে তোলে।
স্কুলে পড়ার সময় থেকেই মাঝে মাঝে খিঁচুনির সমস্যা দেখা দিত। শেফালি জানান, “ক্লাসরুমে বসে থাকতেই খিঁচুনি শুরু হতো। এমনও হয়েছে, রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে পড়ে গেছি। স্কুলের অনুষ্ঠানে ব্যাকস্টেজেও এমন পরিস্থিতিতে পড়েছি।” শারীরিক এই অসুস্থতা তাঁকে মানসিকভাবেও কষ্ট দিয়েছে, যা নিয়ে হতাশায়ও ভুগেছেন বলে জানান তিনি।
শুধু শারীরিক সমস্যাই নয়, ব্যক্তিজীবনেও তিনি মানসিক অস্বস্তির মধ্য দিয়ে গিয়েছেন। জনপ্রিয়তার শীর্ষে থাকাকালেই তিনি ২০০৪ সালে হারমিত সিংকে বিয়ে করেন। কিন্তু সেই দাম্পত্য জীবন ছিল অস্থির। শেফালির অভিযোগ, হারমিত তাঁর ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করতেন। বিষয়টি নিয়ে গণমাধ্যমেও একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। শেষমেশ ২০০৯ সালে তাঁদের বিবাহবিচ্ছেদ হয়।
এরপর এক ডিনার পার্টিতে অভিনেতা পরাগ তিয়াগির সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। দুজন একসঙ্গে একটি রিয়্যালিটি শোতেও অংশ নেন। ধীরে ধীরে সম্পর্ক গড়ে ওঠে এবং ২০১৪ সালে তাঁরা বিয়ে করেন।
জনপ্রিয়তা পেলেও তাঁকে সিনেমায় খুব বেশি দেখা যায়নি। অভিনয়ের প্রস্তাবও তিনি কম পেয়েছেন, যা নিয়ে কিছুটা আক্ষেপ ছিল তার। এই কারণেই এক পর্যায়ে তিনি শুধু স্টেজ শো ও মডেলিং থেকে সরে এসে বোনের কোচিং ব্যবসা শুরু করেন। এছাড়া অসুস্থতার কারণে পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানোর সিদ্ধান্ত নেন। তখন তার স্বাস্থ্যের অবস্থা অনেকটাই ভালো হয় এবং সে বিষয় নিয়ে তিনি আর বেশিক্ষণ কথা বলেননি। বিরতি দিয়ে ২০১৮ সালে তিনি ‘বেবি কাম না’ নামের একটি ওয়েব সিরিজে অভিনয় শুরু করেন। পরের বছর ‘বু: সবকি ফাটেগি’ ওয়েব সিরিজেও দেখা যায় তাকে। একই বছর ‘বিগ বস’ রিয়্যালিটি শোতে অংশ নেন শেফালি। ভক্তরা মনে করেছিলেন, ক্যারিয়ার নতুনভাবে শুরু করতে চলেছেন তিনি, কিন্তু তার পর আবারও বিরতি নেন এবং দীর্ঘ সময় অভিনয় থেকে দূরে ছিলেন।
তখন মিডিয়া তার কাজ ছেড়ে দেওয়ার ব্যাপারে নানা খবর ছড়িয়েছিল। এই প্রসঙ্গে তিনি এক খোলাখুলি সাক্ষাৎকারে কথা বলেন। তিনি বলেছিলেন, “অনেকেই জিজ্ঞেস করেছিলেন কেন আমি আর কাজ চালিয়ে যাইনি। তখন আমি সঠিক উত্তর দিতে পারিনি। এখন বলতে পারি, একমাত্র মৃগী রোগের কারণে আমি কাজ চালিয়ে যেতে পারিনি। কারণ আমি কখন পরবর্তী খিঁচুনি হবে তা বুঝতেই পারতাম না। তবে গত ৯ বছর ধরে আমি সম্পূর্ণ সুস্থ আছি। মানসিক অবসাদ দূর করে শান্তিপূর্ণ জীবনযাপন করছি। এখন আর আমার প্যানিক অ্যাটাক হয় না।”
ধারণা করা হচ্ছে, প্যানিক অ্যাটাকের কারণেই ৪২ বছর বয়সে মডেল ও অভিনেত্রী প্রয়াত হয়েছেন। গতকাল তিনি হঠাৎ অসুস্থ বোধ করলে তাকে দ্রুত মুম্বাইয়ের বেলভিউ মাল্টিস্পেশালিটি হাসপাতালে নেওয়া হয়, যেখানে তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। তার স্বামী পরাগ গণমাধ্যমকে জানান, “শেফালি জারিওয়ালা কার্ডিয়াক অ্যারেস্টে আক্রান্ত হন এবং তাকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি।”
শেফালি শুধুমাত্র ভারতের নয়, বাংলাদেশের গানে মডেল হিসেবে কাজ করেছেন। তরুণ শিল্পী নাদিয়া ডোরার ‘পিরিতির কারবার’ শিরোনামের গানে মডেল হয়েছিলেন। এই গানের কথা, সুর ও সংগীতায়োজন করেছেন তাপস, এবং গানটি ২০২২ সালে প্রকাশিত হয়। এ সময় শ্রোতা-দর্শকরা প্রথমবার জানতে পারেন যে বাংলাদেশের এই গানে শেফালি জারিওয়ালা মডেল ছিলেন। গানটির ভিডিও নির্মাণ করেছেন বলিউডের পরিচালক আদিল শেখ।
শেফালি ১৯৮২ সালের ১৫ ডিসেম্বর ভারতের মুম্বাইয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি গুজরাটের সরদার বল্লভভাই প্যাটেল ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি থেকে ইনফরমেশন টেকনোলজিতে বিএসসি ডিগ্রি অর্জন করেন।
সম্পাদক
এড. গৌরাঙ্গ বসু (ট্রিপল এম.এ)
প্রকাশক
সবুজ বালা
© ২০২৫ আলোকিত জনপদ কর্তৃক সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত