বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী মধ্যে রাজনৈতিক দূরত্ব বা মনোমালিন্য নতুন কোনো বিষয় নয়। দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের সময়ে দুই মিত্র দল কখনো–বা নানা কারণে একে অপর থেকে দূরে সরে গেছে, আবার কখনো রাজনৈতিক কৌশলের অংশ হিসেবে সম্পর্ক মজবুত করেছে। সম্প্রতি লন্ডনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বৈঠক নতুন প্রেক্ষাপট তৈরি করেছে, যার ফলাফল এখনো স্পষ্ট নয়। দুই দলের শীর্ষ নেতারা একে অপরের প্রতি তীর্যক মন্তব্য করছেন। জামায়াত অভিযোগ করছে, অন্তর্বর্তী সরকার এক পক্ষের প্রতি অনানুষ্ঠানিকভাবে পক্ষপাতিত্ব করছে এবং অন্য দলগুলোকে অবহেলা করছে। গণঅধিকার পরিষদ, এনসিপি, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসসহ আরও কয়েকটি দলও এই অভিযোগের সঙ্গে সঙ্গতি পোষণ করেছে।
লন্ডন বৈঠকের পর যৌথ বিবৃতি প্রকাশ এবং এর উপর জামায়াতের অসন্তোষের কারণে গত মঙ্গলবার তারা জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠক বয়কট করে। যদিও পরবর্তীতে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমানের সঙ্গে ফোনে কথা বলেন, এরপর বুধবারের বৈঠকে দলটি অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়। বৈঠকের বিরতিতে জামায়াত, বিএনপি ও এনসিপি নেতারা একে অপরের সঙ্গে সৌজন্য বিনিময়ও করেন এবং সেই মুহূর্তের ছবি-ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। তবে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, সরকার ও ঐকমত্য কমিশন সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ থাকবার চেষ্টা করছে এবং গণঅভ্যুত্থানে অংশ নিয়ে যেসব দল সামনে এসেছে, তাদের সবার গুরুত্ব সমানভাবে বিবেচনা করছে।
বৈঠকের বিষয়বস্তুতে সংস্কার প্রক্রিয়া, অতীতে ছাত্র ও যুবকদের হত্যা-দমন এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিচার, দেশের বন্দর ও করিডোরের উন্নয়নসহ নানা প্রসঙ্গ উঠে আসে। তারেক রহমান ও ড. ইউনূসের বৈঠকের পর ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের কর্মসূচি বাস্তবায়নের যৌথ অঙ্গীকার জানানো হয়। তবে জামায়াতের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের বৈঠকে এ যৌথ বিবৃতিকে ‘দেশীয় রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিপন্থী’ বলে আখ্যায়িত করে নিরপেক্ষতা শঙ্কা ব্যক্ত করা হয়। এর প্রেক্ষিতে তারা দ্বিতীয় পর্যায়ের ঐকমত্য বৈঠক থেকে দূরে থেকেও শেষ পর্যন্ত অংশ নেয়।
অন্যদিকে বিএনপি দাবি করছে, লন্ডন বৈঠক ছিল ‘ঐতিহাসিক’ এবং তারেক ও ড. ইউনূস নির্বাচনের তারিখ নিয়ে একমত হয়েছেন। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথ খোলা তাদের রাষ্ট্রনায়কীর স্বাতন্ত্র্য, আর নির্বাচন নিশ্চিত হলেই বিএনপি ক্ষমতায় আসবে—এ জন্যই কিছু পক্ষের আপত্তি। সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী মনে করেন, অন্তর্বর্তী সরকারকে স্বাভাবিকভাবেই সমর্থন করবে বিএনপি, আর যে কোনো অসঙ্গতি আলাপ-আলোচনা করে সমাধান করা উচিত।
গণঅধিকার পরিষদের নুরুল হক নুর, এনসিপির আরিফুল ইসলাম আদিব ও খেলাফত মজলিসের জালালুদ্দীন আহমদসহ কয়েকটি দলও সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তারা মনে করছেন, যদি ইতিমধ্যে কোনো দলকে ‘বড়’ বা ‘মেজরিটি’ বলে চিহ্নিত করা হয়, তাহলে রাজনৈতিক সংস্কারের সার্বজনীন স্বাতন্ত্র্য নষ্ট হতে পারে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কাজী মাহবুবুর রহমান বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোকে বিভক্ত না হয়ে একে অপরকে সহযোগিতা করে নতুন বাংলাদেশ গড়ার কাজে একতার পরিচয় দিতে হবে, যা বাঁধাগ্রস্ত করবে না বরং শক্তিশালী করবে।
Leave a Reply