মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার কদমবাড়ী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এবং নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী লীগের (ইউপি) সাধারণ সম্পাদক বিধান বিশ্বাসকে গ্রেফতার করেছে রাজৈর থানা পুলিশ।
গত শুক্রবার (৬ জুন) রাত ৮টার দিকে কদমবাড়ী বাজার থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়। তিনি আড়ুয়াকান্দি গ্রামের অর্জুন বিশ্বাসের ছেলে।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ২০২৪ সালের ২৪ নভেম্বর বিএনপি দলীয় গেট ভাঙচুর, লুটপাট এবং বোমা বিস্ফোরণের ঘটনায় রাজৈর থানায় মামলা দায়ের করেছিলেন পাঠানকান্দি গ্রামের শাহ আলম শেখ ওরফে কোব্বাস শেখ। ওই মামলায় কদমবাড়ী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বিধান বিশ্বাসকে ৩২ নম্বর আসামি করা হয়। এরপর থেকেই তিনি পলাতক ছিলেন। তবে স্থানীয়দের অভিযোগ, গ্রেফতারের আগপর্যন্ত তিনি তার ওষুধের দোকানে প্রতিদিন বসতেন এবং দোকান চালাতেন। পুলিশ তাকে গ্রেফতার না করায় এলাকায় নানা প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছিল।
এলাকাবাসী এবং বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, বিধান বিশ্বাস আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য, সাবেক নৌপরিবহন মন্ত্রী এবং মাদারীপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য শাজাহান খানের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত। এলাকায় খাল খননসহ বিভিন্ন কাজেই তার একক প্রভাব ছিল এবং তার লাঠিয়াল বাহিনীর কারণে সাধারণ মানুষ এখনো মুখ খোলার সাহস পায় না।
রাজৈর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ মাসুদ খান বলেন, “চেয়ারম্যান বিধান বিশ্বাস ওই মামলার এজাহারভুক্ত আসামি। তাকে গ্রেফতার করে থানায় আনা হয়েছে এবং আদালতে সোপর্দ করা হবে।”
এছাড়া বিধান বিশ্বাসের বিরুদ্ধে দুদকেও (মামলা নং-২৩/১, মাদারীপুর জেলা) মামলা রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, তিনি চেয়ারম্যান থাকাকালীন এলজিএসপি-৩ প্রকল্পের বিভিন্ন কাজ না করেও অর্থ আত্মসাৎ করেছেন। কিছু প্রকল্পের তালিকা নিচে উল্লেখ করা হলো:
১. নটাখোলা কেনাই বিশ্বাসের বাড়ির নিকট ব্রিজ থেকে গবিন্দ বৈদ্যের বাড়ি পর্যন্ত ইটের সোলিং (২০১৭-১৮), বরাদ্দ: ২,৫০,০০০ টাকা।
২. কদমবাড়ী ইউনিয়ন মহাবিদ্যালয়ের টয়লেট নির্মাণ (২০১৭-১৮), বরাদ্দ: ২,০০,০০০ টাকা।
৩. আ.ন.ব. উচ্চ বিদ্যালয়ের দ্বিতল দেয়াল ও টিনসেড নির্মাণ (২০১৭-১৮), বরাদ্দ: ২,৫০,০০০ টাকা।
৪. ইকরাবাড়ি বরুণ গাইনের ইরি ব্লকের ড্রেন নির্মাণ (২০১৬-১৭), বরাদ্দ: ১,৩০,০০০ টাকা।
৫. কদমবাড়ী ইউনিয়নে মশক নিধনের ফগার মেশিন (২০১৮-১৯), বরাদ্দ: ১,৪০,০০০ টাকা।
৬. কদমবাড়ী পাকা রাস্তা থেকে সমীর মণ্ডলের বাড়ি পর্যন্ত ইটের সোলিং (২০১৭-১৮), বরাদ্দ: ১,২০,০০০ টাকা।
তাছাড়া ১% ফান্ডের আওতায়ও তিনি প্রকল্প বাস্তবায়ন না করেই অর্থ আত্মসাৎ করেছেন। যেমন:
ক) আড়ুয়াকান্দি দিঘিরপাড় বিলে ড্রেন কেটে পাইপ বসানো (২০১৭-১৮), বরাদ্দ: ১,০০,০০০ টাকা।
খ) আড়ুয়াকান্দি পুকুরিয়া পাকা রাস্তা থেকে ধিতান বিশ্বাসের বাড়ি পর্যন্ত বৃক্ষরোপণ (২০১৭-১৮), বরাদ্দ: ৫০,০০০ টাকা।
গ) আড়ুয়াকান্দি রসিক লালের বাড়ি হরি মন্দির নির্মাণ (২০১৭-১৮), বরাদ্দ: ১,০০,০০০ টাকা।
চেয়ারম্যান ও মেম্বারদের সম্মানি ভাতা বাবদ বরাদ্দের অজুহাতে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগও রয়েছে:
৭. ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৩,৩০,০০০ টাকা।
৮. ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ২,০৩,০০০ টাকা।
চৌকিদারি ট্যাক্সের অনিয়মও রয়েছে:
৯. ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৭,০০,০০০ টাকা।
১০. ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৪,৫০,০০০ টাকা।
১১. জন্ম সনদ, মৃত্যু সনদ এবং ট্রেড লাইসেন্স খাত থেকে ৪ বছরে প্রাপ্ত ৫,০০,০০০ টাকা।
এছাড়া এলজিএসপি-৩ এর ওভারল্যাপিং প্রকল্পেরও টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে, যেমন:
১২. অবিনাশ বিশ্বাসের বাড়ি থেকে বিষ্ণু মন্দির পর্যন্ত ইটের সোলিং (২০১৭-১৮), বরাদ্দ: ১,৫০,০০০ টাকা।
১৩. বড়খোলা প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পরেশ হাজরার বাড়ি পর্যন্ত ইটের সোলিং (২০১৭-১৮), বরাদ্দ: ১,৫০,০০০ টাকা।
১৪. কদমবাড়ী বাজারে অনন্ত বিশ্বাসের দোকানের সামনে থেকে গোপাল বাংলার দোকান পর্যন্ত রাস্তা উন্নয়ন (২০১৭-১৮), বরাদ্দ: ১,৩০,০০০ টাকা।
১৫. দিঘিরপাড় মহামানব গণেশ পাগল নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে বেঞ্চ সরবরাহ (২০১৮-১৯), বরাদ্দ: ১,৫০,০০০ টাকা।
১৬. বড়খোলা রাজা হালদারের বাড়ি থেকে শ্যামল বাড়ৈর বাড়ি পর্যন্ত ইটের সোলিং (২০১৭-১৮), বরাদ্দ: ১,২০,০০০ টাকা।
১৭. মৃধাবাড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের আসবাবপত্র (২০১৭-১৮), বরাদ্দ: ১,০০,০০০ টাকা—যা সরবরাহ না করে টাকা আত্মসাৎ।
অভিযোগ রয়েছে, তিনি সাবেক মন্ত্রীর আশীর্বাদে বারবার তদন্ত থেকে বাঁচতেন। সাধারণ মানুষের দাবি, এ ধরনের ক্ষমতার অপব্যবহারকারী ও সন্ত্রাসী বাহিনী লালনকারী বিধান বিশ্বাসসহ তার সহযোগীদের দ্রুত গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনলে এলাকায় শান্তি, ন্যায়বিচার ও আইনের শাসন ফিরে আসবে।
Leave a Reply