শুক্রবার, ২৭ জুন ২০২৫, ১১:০৪ পূর্বাহ্ন

বিআইডব্লিউটিএ’র ড্রেজিং বিভাগ যেন টাকার খনি দুর্নীতিবাজরা সব আমলেই ধরাছোঁয়ার বাইরে

নিজস্ব প্রতিবেদক
  • Update Time : বুধবার, ৪ জুন, ২০২৫
  • ৪০৪ Time View

একটি বড় ড্রেজারে কর্মরত প্রথম শ্রেণির ড্রাইভার আক্ষেপ করে বললেন, ‘জাহাজ (ড্রেজার) চালাই আমরা। আর আমিই জানলাম না, কবে আমার জাহাজ স্পেশাল ডকিং ও ওভারহোলিং (ডকইয়ার্ডে নিয়ে বিশেষভাবে ব্যয়বহুল মেরামত) করা হলো। অথচ ডকিং বাবদ সাত লাখ টাকা বিল করা হলো, আমার কাছ থেকে স্বাক্ষর নেয়া হলো, চাকরি বাঁচাতে আমি বাধ্য হয়ে স্বাক্ষরও দিলাম।’

এই হচ্ছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) বিশাল ড্রেজিং বিভাগের বহরে থাকা অর্ধশত সচল ড্রেজারের একটির কাল্পনিক মেরামত ব্যয় দেখিয়ে টাকা আত্মসাতের ঘটনা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই ড্রাইভার জানান, শুধু তার জাহাজ নয়; প্রত্যেক জাহাজ দুই-তিন বছর পর এভাবে স্পেশাল ডকিংয়ের নামে ভৌতিক বিল পরিশোধ দেখানো হয়। এছাড়া সারা বছর ড্রেজারগুলো মেরামত বাবদ এবং ড্রেজার ও টাগবোটে ব্যবহৃত জ্বালানিখাত থেকে কোটি কোটি টাকা অত্মসাত করা হচ্ছে।

এদিকে সম্প্রতি নারায়নগঞ্জ থেকে বিআইডব্লিউটিএর একটি জাহাজের মালামাল চুরি হয়। এর আগেও নারায়নগঞ্জের খানপুর ড্রেজার বেইজ এবং আরিচা ড্রেজার বেইজে থেকেও বিভিন্ন সময় মালামাল চুরিসহ রহস্যজনক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। যেসব ঘটনার তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি প্রতিবেদন দাখিল করলেও তা কখনো আলোর মুখ দেখে না। নাম প্রকাশ না করা শর্তে
বিআইডব্লিউটিএর কয়েকজন কর্মচারী জানান, চুরি বলেন আর আগুন বলেন, সবই নাটক। লুটপাট করার জন্যই পরিকল্পিতভাবে এসব করা হয়।

সবশেষ নারায়নগঞ্জে জাহাজের মালামাল চুরির ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান বিআইডব্লিউটিএর তত্ত¦াবধায়ক প্রকৌশলী (যান্ত্রিক) শহিদুল ইসলাম বলেন, চুরি বিষয়ে তদন্ত চলছে, তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত কোন মন্তব্য করা যাবে না।

যদিও বিআইডব্লিউটিএর বিরুদ্ধে সঠিকভাবে নদী খনন ও ড্রেজিং না করে বরাদ্দের ৩০-৪০ শতাংশ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ বহু আগের; তবুও অদৃশ্য কারণে এদের বিরুদ্ধে কোনো প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেয়া হয় না। এমনকি দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এই বিভাগের উচ্চপদস্থ প্রকৌশলীদের বিরুদ্ধে একাধিকবার আলাদা আলাদা অনুসন্ধান টিম গঠন করলেও অদৃশ্য কারণে শাস্তির আওতায় আসছেন না অভিযুক্তরা। তবে দুদকের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র মতে, ড্রেজিং বিভাগের কয়েকজন প্রভাবশালী প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে খুব শিগগির দৃশ্যমান পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে। তাদের মধ্যে রয়েছেন রকিবুল ইসলাম তালুকদার, সাইয়েদুর রহমান, মোহাম্মদ মজনু মিয়া।

এছাড়া সংস্থাটির বিভিন্ন বিভাগের আরো অন্তত ২০ জন কর্মকর্তা ও কর্মচারি দুদকের কড়া নজরদারিতে আছেন।
অভিযোগ রয়েছে, অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. মজনু মিয়া দীর্ঘ আট বছর যাবত ড্রেজারবেইজের প্রধান থাকাকালে ড্রেজারগুলো সংরক্ষণ, পরিচালন ও মেরামত খাত থেকে অন্তত পঞ্চাশ কোটি টাকা আত্মসাত করেছেন। পরবর্তী সময়ে তাকে অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী পদে পদোন্নতি দেয় কর্তৃপক্ষ। এরপর মজনু মিয়াকে করা হয়েছে প্রায় সাড়ে চার হাজার কোটি টাকার ৩৫ ড্রেজার ক্রয় প্রকল্পের পরিচালক (পিডি)।

তবে ড্রেজারবেইজ থেকে আত্মসাত করা টাকা শুধু মজনু মিয়ার পকেটে গেছে, তা নয়। এই টাকার একাংশ বর্তমান প্রধান প্রকৌশলী (তৎকালীন অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী) রকিবুল ইসলাম তালুকদার এবং আরেক অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী ছাইয়েদুর রহমানের পকেটেও গেছে।

বিগত সরকারের আমলে প্রচণ্ড প্রভাবশালী প্রকৌশলীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ছাইয়েদুর রহমান। তার বিরুদ্ধে দুদকের ঢাকা ও ময়মনসিংহ অফিস আলাদা অনুসন্ধান টিম গঠন করে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতির তথ্য উদঘাটন করলেও শাস্তির আওতায় আনা হয়নি। তবে সরকার বদল হলেও ছাইয়েদুর রহমান এখনো প্রভাবশালী। তাকে ড্রেজিং বিভাগ থেকে কয়েক মাস আগে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চট্টগ্রামে অফিসে বদলি করা হলেও তিনি অফিস করছেন ঢাকায় বসে এবং যথারীতি ড্রেজিং বিভাগও নিয়ন্ত্রণ করছে।

প্রসঙ্গত, পতিত আওয়ামী লীগ আমলেই রকিবুল ইসলাম তালুকদার প্রধান প্রকৌশলী, ছাইয়েদুর রহমান অতিরিক্ত প্রকৌশলী এবং মজনু মিয়া অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী পদে পদোন্নতি বাগিয়ে নিয়েছেন। আবার স্বৈরাচার শেখ হাসিনার পতন হলেও তাদের গায়ে কোনো আঁচড় লাগেনি। তবে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর ভোল পাল্টে জাতীয়তাবাদী সেজেছেন তারা।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের তথ্যমতে, ড্রেজিং বিভাগের বর্তমান প্রধান প্রকৌশলী রকিবুল ইসলাম তালুকদারের আশীর্বাদে মজনু মিয়া প্রকল্পের পিডি হয়েছেন। মূলত তারা এখন প্রধান প্রকৌশলীর ঘনিষ্ঠ সহযোগী এবং ড্রেজিং বিভাগের বিভিন্ন অপকর্মের হোতা।

এদিকে, নদী খনন ও ড্রেজিংয়ে সীমাহীন দুর্নীতি ও অর্থ লোপাট এবং রকিবুল তালুকদারের বিপুল অর্থবিত্ত ও অবৈধ সম্পদ নিয়ে দুদক অনুসন্ধান শুরু করার পর নৌ মন্ত্রণালয় ও বিআইডব্লিউটিএসহ নৌ সেক্টরজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে।

তার বিরুদ্ধে দুদকের জোর অনুসন্ধানের পাশাপাশি উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন হতে পারে। এছাড়া রকিবুলের বিরুদ্ধে যেকোনো সময় প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হতে পারে বলেও শোনা যাচ্ছে।
নাব্যতা সঙ্কট দূর করে সারা বছর নৌপথ সচল রাখতে নিয়মিত নদী ড্রেজিং বা পলি অপসারণের জন্য বিআইডব্লিউটিএর বহরে ড্রেজারের সংখ্যা ৪৫। এই বহরে আরো ৩৫টি যুক্ত হতে যাচ্ছে। এসব ড্রেজার সংরক্ষণ, পরিচালন ও মেরামতের জন্য আলাদা আলাদা ড্রেজারবেইজ আছে।

এর মধ্যে পদ্মা সেতু চালুর আগে মাওয়া ও নারায়ণগঞ্জ ড্রেজার বেইস সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এ দুই বেইসের অধীনে যেমন বেশিসংখ্যক ড্রেজার ছিল, তেমনি এগুলোর পরিচালন, রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামত খরচও ছিল অনেক বেশি। পদ্মা সেতুর কারণে মাওয়া ড্রেজার বেইসের গুরুত্ব কমে গেলেও নারায়ণগঞ্জেরটা এখনো গুরুত্বপূর্ণ।
নারায়ণগঞ্জ ড্রেজার বেইসের প্রধান ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার মো. মজনু মিয়া। সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, তিনি দীর্ঘ প্রায় আট বছর এ বেইসের প্রধান ছিলেন। সেখানে দায়িত্ব পালনকালে নৌপথের পলি অপসারণের নামে ড্রেজারের জ্বালানি তেল ক্রয় এবং ড্রেজার রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতের নামে সীমাহীন অর্থ লুটপাট করেছেন তারা।

এই বিভাগের সাবেক ও বর্তমান কয়েকজন সিনিয়র কর্মকর্তা/প্রকৌশলী এবং কর্মচারীদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, ড্রেজার পরিচালনার জন্য জ্বালানি তেল ক্রয়, ড্রেজারগুলো যথাযথভাবে সংরক্ষণ ও মেরামতের সব দায়িত্ব ও কর্তৃত্ব সংশ্লিষ্ট ড্রেজার বেইসের। এখানে অর্থ লুটপাটের কয়েকটি খাত রয়েছে।
সূত্র জানায়, প্রতিটি ড্রেজারের ইঞ্জিন মিটার ১০ শতাংশ টেম্পারিং করা। ড্রেজিংয়ের জন্য ৯০ লিটার তেল লোড করলে ১০০ লিটার শো করে (দেখায়)।

একটি ড্রেজার দৈনিক ১২ ঘণ্টা চললে কাগজে-কলমে ১৮ ঘণ্টা দেখিয়ে দেড় গুণ বেশি জ্বালানি ব্যয় দেখানো হয়। ড্রেজার এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নেয়ার জন্য টাগবোটের ইঞ্জিনে যে পরিমাণ জ্বালানি প্রয়োজন হয়, তার চেয়ে অনেক বেশি দেখানো হয়। যদি ৫০০ লিটার খরচ হয়, সেখানে দেখানো হয় ১ হাজার লিটার।
এভাবে দুর্নীতির মাধ্যমে প্রতিটি ড্রেজার থেকে মাসে অন্তত ৬ লাখ টাকা লুটপাট হয়। এই টাকার ৫০ শতাংশ পান বেইসপ্রধান। বাকি ৫০ শতাংশ তার অধীনস্থদের মধ্যে ভাগবাঁটোয়ারা হয়।

এভাবে নারায়ণগঞ্জের মতো গুরুত্বপূর্ণ বেইসের অধীনে থাকা ড্রেজারের তেল ক্রয় খাত থেকে প্রতি মাসে চুরি হয় ৩০ লাখ টাকা হিসেবে ৩ কোটি ৬০ লাখ পেয়েছেন মজনু মিয়া। এই হিসাবে নারায়ণগঞ্জ ড্রেজার বেইসের প্রধান থাকাকালে আট বছরে শুধু জ্বালানি খাত থেকে অবৈধ আয় হয়েছে ১৪ কোটি ৪০ লাখ টাকা।
তবে এর চেয়ে চুরি বা অর্থ লোপাট বেশি হয় ড্রেজার সংরক্ষণ খাতে। আর মেরামত খাতে হয় পুকুরচুরি। সেসব ভয়ঙ্কর অনেক তথ্যও এরই মধ্যে আসতে শুরু করেছে।

একাধিক সূত্রে জানা গেছে, র‌্যাবের সাবেক মুখপাত্র এবং চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরের সাবেক চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল (অব.) সোহায়েল আহমেদ (বর্তমানে গ্রেফতার হয়ে কারাগারে) রকিবুল ইসলাম তালুকদারের স্ত্রীর বড় ভাই।

সাবেক হুইপ মির্জা আজম, নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সাবেক মন্ত্রী শাজাহান খান ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, সাবেক এমপি শেখ হেলাল, সাবেক চিফ হুইপ নূর-ই আলম চৌধুরী লিটনসহ আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী মন্ত্রী-এমপিদের ক্ষমতার অপব্যবহার করে রকিবুল ইসলাম তালুকদার গত সরকারের আমলে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি ও সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেছেন। ক্ষমতার জোরে তিনি বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান, সদস্য কাউকে পাত্তা দেন না।

রকিবুল ইসলাম তালুকদার নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে নোয়াখালী-১ আসনের সাবেক এমপি আনোয়ার হোসেন খানের ড্রেজিং প্রতিষ্ঠানে সাবেক এমপি শেখ হেলাল এবং সাবেক চিফ হুইপ লিটন চৌধুরী, সালমান এফ রহমানের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পনিরুজ্জামান (তরুণ) গংয়ের নামে বেনামীয় বিভিন্ন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে শত শত কোটি টাকার ড্রেসিংয়ের কাজ দিয়েছেন।

রকিবুল ইসলাম তালুকদার সাবেক নৌমন্ত্রী শাজাহান খান, সাবেক প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরীর প্রধান সহযোগী হিসেবে কাজ করেছেন। অভিযোগ রয়েছে, বর্তমানে প্রধান প্রকৌশলী রকিবুল ইসলাম তালুকদারের মাধ্যমেই নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সাবেক দুই মন্ত্রী হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন।
সাবেক প্রধানমন্ত্রীর মূখ্য সচিব তোফাজ্জল হোসেন মিয়ার সঙ্গে ছিল রকিবুল ইসলাম তালুকদারের অবৈধ লেনদেন।

এ বিষয়ে জানতে অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. মজনু মিয়ার মুঠোফোনে কল করলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি। এমনকি ক্ষুদে বার্তা পাঠালেও কোন জবাব দেনননি।
প্রধান প্রকৌশলী রকিবুল ইসলাম তালুকদার বলেন, এসব অভিযোগের কোন সত্যতা নেই। এগুলো মিথ্যা ও ভিত্তিহীন।

ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category
Adsense