বিশ্ব সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি কাজী নজরুল ইসলাম শুধু বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদই নন, তিনি ছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম স্বপ্নদ্রষ্টা। ১৯৭১ সালের ২৫ মে, মুক্তিযুদ্ধের উত্তাল সময়ে, জাতীয় কবির জন্মদিনে উদ্বোধন হয় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। সেদিন “বিদ্রোহী থেকেই বিদ্রোহ” হয়ে উঠেছিল বাস্তব আন্দোলনের প্রেরণা। ব্রিটিশবিরোধী সলঙ্গা বিদ্রোহ থেকে শুরু করে ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থান পর্যন্ত নজরুলের কবিতা, গান ও বাণী জাতিকে শুধু অনুপ্রাণিতই করেনি—মনে হয়েছে, তিনি যেন আন্দোলনের সামনের সারিতে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
রোববার, ২৫ মে বিকেল পাঁচটায় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির এক্সপেরিমেন্ট থিয়েটার হলে “বিদ্রোহী – দ্যা নজরুল সেন্টার” আয়োজিত এক আলোচনা সভায় এসব কথা বলেন নজরুল গবেষক ও কবি আল মুজাহিদী। অনুষ্ঠানটি ছিল জাতীয় কবির ১২৬তম জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে আয়োজিত “বিদ্রোহ থেকে বিদ্রোহী” শীর্ষক আলোচনা সভা।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ১২৬তম নজরুল জন্মজয়ন্তী উদযাপন কমিটির চেয়ারম্যান ও কাঙ্ক্ষিত বাংলাদেশের সভাপতি, সাবেক কর কমিশনার মো. আসাদুজ্জামান। উদ্বোধন করেন বিদ্রোহী কবিতার শতবর্ষ উদযাপন জাতীয় কমিটির মহাসচিব ও রাষ্ট্রচিন্তক ড. শাহরিয়ার ইফতেখার ফুয়াদ। প্রধান আলোচক ছিলেন বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের সাবেক সচিব ড. মোহাম্মদ জকরিয়া। স্বাগত বক্তব্য দেন সংস্কৃতজন মুহাম্মদ আতা উল্লাহ খান।
অনুষ্ঠানে নজরুল সম্মাননা ২০২৫ প্রদান করা হয় কবি ও গবেষক আল মুজাহিদী, নজরুল সংগীত শিল্পী ফাতেমা তুজ জোহরা এবং লেখক এটিএম ফারুক আহমেদকে। সহ-আয়োজক হিসেবে ছিল বাংলাদেশ সাপোর্টারস ফোরাম ও দেশ নাট্যদল; মিডিয়া পার্টনার ছিল দৈনিক নিরপেক্ষ।
ড. শাহরিয়ার ইফতেখার ফুয়াদ বলেন, “সাম্য, মানবতা, প্রেম ও প্রকৃতির কবি নজরুলের জীবন ও কর্ম চিরকাল জাতির প্রেরণার উৎস। তাঁর স্বপ্ন ছিল বৈষম্যহীন ও অসাম্প্রদায়িক সমাজ গঠন।” তিনি জানান, ২০২১ সাল থেকে ‘বিদ্রোহী’ কবিতার শতবর্ষ উপলক্ষে নানা কর্মসূচির মাধ্যমে তরুণ সমাজকে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে, যার ধারাবাহিকতায় ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানে নজরুলের বাণী ছিল প্রধান প্রেরণা।
প্রধান আলোচক ড. মোহাম্মদ জকরিয়া বলেন, “নজরুল তাঁর দেশপ্রেম, প্রতিবাদী কবিতা ও সংগীত দিয়ে বাঙালিকে স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখিয়েছেন। ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানে তাঁর চেতনা মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল।”
সভাপতির বক্তব্যে মো. আসাদুজ্জামান বলেন, “নজরুল ছিলেন একাধারে কবি, সংগীতজ্ঞ, নাট্যকার, উপন্যাসিক এবং একজন অসাম্প্রদায়িক মানবতাবাদী। তাঁর জন্মজয়ন্তী আমাদের জন্য প্রেরণার উৎস।” তিনি নজরুল উৎসবের নানা আয়োজনের স্মৃতিচারণাও করেন।
নজরুল সম্মাননা গ্রহণ করে এটিএম ফারুক বলেন, “কাজী নজরুল ছিলেন বিশ শতকের প্রগতিশীল সাহিত্যচর্চার অগ্রনায়ক। তাঁর কবিতা মানুষের ওপর অত্যাচার ও শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রতীক। সাহিত্য, সংস্কৃতি ও রাজনীতির অঙ্গনে তাঁর ভূমিকা ছিল অনন্য।”
সংস্কৃতিজন মুহাম্মদ আতা উল্লাহ খান বলেন, “নজরুলের অগ্নিঝরা লেখনি তাঁকে ‘বিদ্রোহী কবি’ উপাধি দিয়েছে। হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতির প্রতীক ছিলেন তিনি। তাঁর ইসলামী সংগীত ও গজল যেমন জনপ্রিয়, তেমনি শ্যামাসঙ্গীতও সমানভাবে সমাদৃত।”
অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন জাতীয় নারী সাহিত্য পরিষদের সহ-সভাপতি কবি অধ্যক্ষ রাফিকা আফরোজ, সাধারণ সম্পাদক নাসরিন ইসলাম শেলী, কবি সুলতানা রাজিয়া, অভিনেত্রী ও নৃত্যশিল্পী সুলতানা চৌধুরী, কবি ইসমত আরা ও আবৃত্তিকার সাইদুল ইসলাম সাইদ।
আলোচনা সভার শেষে মঞ্চস্থ হয় কাজী নজরুল ইসলামের গল্প অবলম্বনে রচিত নাটক অগ্নিগিরি। নাটকটি পরিবেশন করে দেশ নাট্যদল। শুরুর আগে নাট্যকার রাস্না হিমেল অনুভূতি প্রকাশ করেন।
এর আগে সকাল সাড়ে ৭টায় কাজী নজরুল ইসলামের সমাধিতে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন জাতীয় কমিটির মহাসচিব ও নজরুল গবেষক প্রফেসর ড. সিরাজুল ইসলাম। বিশেষ অতিথি ছিলেন সাবেক রাষ্ট্রদূত ও নজরুল একাডেমির সভাপতি মসয়ুদ মান্নান এবং কবি তাহেরা খাতুন।
Leave a Reply